ভারতীয় ইতিহাসের কিছু বিস্মৃত ঘটনা: বঙ্গে গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী
পঞ্চদশ শতাব্দীতে কবি বিপ্রদাস পিপিলাই মনসামঙ্গলে লিখে গেছেন 'গঙ্গা আর সরস্বতী/ যমুনা বিশাল অতি/ অধিষ্ঠান উমা মহেশ্বরী।' ১৬৬০ সালে ভূতাত্ত্বিক ভ্যান ডি ব্রুক ভারতের, বিশেষত অবিভক্ত বঙ্গদেশের অনেকগুলি নকশা এঁকে গেছেন। কালের স্রোতে তার থেকে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বিভিন্নসুত্র থেকে একদম শুরুর কথা যা পাওয়া যায় তা হোল জুরাসিক যুগে প্রায় ১৮ কোটি বছর আগে যখন গণ্ডয়ানা অনেকগুলো টুকরোয় ভেঙ্গে যায়, তখন সৃষ্টি হয় গঙ্গা ও ব্ৰহ্মপুত্ৰের। ধীরে ধীরে পলি জমে সৃষ্টি হয় অন্তর্বর্তী বদ্বীপের এবং আরও পরে গঠন হয় বঙ্গোপসাগরের তটরেখার। পৌরাণিক মতে গঙ্গা নদী নয় – একটি খাল। এটির খনন করেছিলেন কোশালার (অধুনা উত্তরপ্রদেশের অবধ) সাগর রাজার ছেলে ভগীরথ। এই বিতর্কের মধ্যে এখন না গিয়ে দেখে নেওয়া যাক গত পাঁচশ বছরে এই গুরুত্বপূর্ণ নদী ও তার শাখানদীগুলির আদি পথ এবং পরবর্তী গতি পরিবর্তন।
হুগলী জেলার সপ্তগ্রাম ও ত্রিবেণী ঐতিহাসিক এবং ভৌগলিক দুদিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। সপ্তগ্রাম ছিল একটি প্রধান নদীবন্দর, প্রধান শহর এবং প্রাচীন এবং মধ্যযুগীয় সময়ে কখনও কখনও দক্ষিণ বাংলার রাজধানী। ত্রিবেণী হোল গঙ্গা ও তার দুই প্রধান শাখানদী যমুনা ও সরস্বতীর সঙ্গমস্থল। ষোড়শ শতকেও ত্রিবেণী থেকে দক্ষিণ পশ্চিম দিক ধরে সপ্তগ্রাম হয়ে বয়ে চলত সরস্বতী নদী। যমুনা বইত দক্ষিণ পূর্ব দিক ধরে। আর মূলধারা ভাগীরথী বা হুগলী নাম নিয়ে বইত মাঝামাঝি। খোঁজ করলে ত্রিবেণী (Tribeni) নামটিকে অনেকগুলি জায়গায় পাওয়া যাবে। যেমন নেপালে দুটি ত্রিবেণী (Tribeni) আছে – একটি ধবলগিরি অঞ্চলে পারবাত জেলায়, অন্যটি রাপ্তি অঞ্চলে সাল্যান জেলায়। ভারতেও দুটি ত্রিবেণী আছে – একটি এই হুগলীর, অন্যটি ঘটনাচক্রে এলাহাবাদের কাছে গঙ্গা ও উত্তর ভারতের যমুনা ও সরস্বতীর সঙ্গমস্থলের নামও ত্রিবেণী (Triveni) সঙ্গম।
সপ্তগ্রাম তৈরী সাতখানি গ্রাম নিয়ে – বাঁশবেড়িয়া, কৃষ্টপুর, বাসুদেবপুর, নিত্যানন্দপুর, শিবপুর, সাম্বাচোরা ও বলদঘাটি। সপ্তগ্রাম ও ত্রিবেণী ঘিরে একটি পৌরাণিক কাহিনী আছে। কন্নৌজের রাজা প্রিয়বান্তার সাত পুত্র ছিল –অগ্নিত্র, মেধাতিথি, বাপুষ্মান, জ্যোতিষ্মান, দ্যুতিষ্মান, সবান এবং ভাব্য। এঁরা রাজকীয় জীবনযাত্রা ও ভোগবিলাসে বিরক্ত হয়ে বেড়িয়ে পরেন এক নতুন জায়গার খোঁজে – যেখানে ওঁরা ধ্যানযোগ করতে পারেন। ঘুরতে ঘুরতে গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতীর সঙ্গমস্থলে এসে জায়গাটি এতো পছন্দ হয়ে যায় যে তপস্বীর জীবনযাপন করার জন্যে তাঁরা সাতখানি গ্রাম স্থাপন করেন। এই সপ্তগ্রামের অবস্থান বর্তমানে হুগলী জেলার মুখ্য শহর ও রেল জংশন ব্যান্ডেল থেকে মাত্র ৪ কিমি দুরত্বে। যদিও উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে – যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরে ভারতে রেল বিপ্লব ঘটেনি – তখন এখানে কয়েকটি মাত্র কুঁড়ে ঘর ছিল। কারণ এটি যে সরস্বতী নদীর তীরবর্তী বন্দর ছিল – সেই নদীটির কালের গর্ভে মজে যাওয়া এবং জব চার্নকের হাত ধরে কলকাতা বন্দরের শ্রীবৃদ্ধি
মনসামঙ্গল অনুসারে চাঁদ সওদাগর ছিলেন অধুনা আসামের কামরূপ জেলার ছয়গাও তথা তৎকালীন চম্পক নগরের প্রভাবশালী বণিক। ছয়গাও (ছয়গাঁ) ও সপ্তগ্রাম (সাতগাঁ)-এর মাঝামাঝি ব্ৰহ্মপুত্ৰের তীরবর্তী জনপদ ছিল অধুনা বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার বগুড়া – যেখানে বেহুলা ও লখিন্দরের লোহার বাসরের প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। এই রচনাটি মনসামঙ্গলের উপর নয় – কিন্তু তথ্যগুলি উল্ল্যেখ করা হল যাতে তখন নদীমাতৃক বঙ্গদেশের বানিজ্য পথগুলির একটা ধারনা করা যায়। পরিশেষে চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্যপোতের সাগরযাত্রার পথটি ছিল – সপ্তগ্রাম থেকে উজানে ত্রিবেণী সঙ্গম।
পঞ্চদশ শতাব্দীতে কবি বিপ্রদাস পিপিলাই মনসামঙ্গলে লিখে গেছেন 'গঙ্গা আর সরস্বতী/ যমুনা বিশাল অতি/ অধিষ্ঠান উমা মহেশ্বরী।' ১৬৬০ সালে ভূতাত্ত্বিক ভ্যান ডি ব্রুক ভারতের, বিশেষত অবিভক্ত বঙ্গদেশের অনেকগুলি নকশা এঁকে গেছেন। কালের স্রোতে তার থেকে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বিভিন্নসুত্র থেকে একদম শুরুর কথা যা পাওয়া যায় তা হোল জুরাসিক যুগে প্রায় ১৮ কোটি বছর আগে যখন গণ্ডয়ানা অনেকগুলো টুকরোয় ভেঙ্গে যায়, তখন সৃষ্টি হয় গঙ্গা ও ব্ৰহ্মপুত্ৰের। ধীরে ধীরে পলি জমে সৃষ্টি হয় অন্তর্বর্তী বদ্বীপের এবং আরও পরে গঠন হয় বঙ্গোপসাগরের তটরেখার। পৌরাণিক মতে গঙ্গা নদী নয় – একটি খাল। এটির খনন করেছিলেন কোশালার (অধুনা উত্তরপ্রদেশের অবধ) সাগর রাজার ছেলে ভগীরথ। এই বিতর্কের মধ্যে এখন না গিয়ে দেখে নেওয়া যাক গত পাঁচশ বছরে এই গুরুত্বপূর্ণ নদী ও তার শাখানদীগুলির আদি পথ এবং পরবর্তী গতি পরিবর্তন।
হুগলী জেলার সপ্তগ্রাম ও ত্রিবেণী ঐতিহাসিক এবং ভৌগলিক দুদিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। সপ্তগ্রাম ছিল একটি প্রধান নদীবন্দর, প্রধান শহর এবং প্রাচীন এবং মধ্যযুগীয় সময়ে কখনও কখনও দক্ষিণ বাংলার রাজধানী। ত্রিবেণী হোল গঙ্গা ও তার দুই প্রধান শাখানদী যমুনা ও সরস্বতীর সঙ্গমস্থল। ষোড়শ শতকেও ত্রিবেণী থেকে দক্ষিণ পশ্চিম দিক ধরে সপ্তগ্রাম হয়ে বয়ে চলত সরস্বতী নদী। যমুনা বইত দক্ষিণ পূর্ব দিক ধরে। আর মূলধারা ভাগীরথী বা হুগলী নাম নিয়ে বইত মাঝামাঝি। খোঁজ করলে ত্রিবেণী (Tribeni) নামটিকে অনেকগুলি জায়গায় পাওয়া যাবে। যেমন নেপালে দুটি ত্রিবেণী (Tribeni) আছে – একটি ধবলগিরি অঞ্চলে পারবাত জেলায়, অন্যটি রাপ্তি অঞ্চলে সাল্যান জেলায়। ভারতেও দুটি ত্রিবেণী আছে – একটি এই হুগলীর, অন্যটি ঘটনাচক্রে এলাহাবাদের কাছে গঙ্গা ও উত্তর ভারতের যমুনা ও সরস্বতীর সঙ্গমস্থলের নামও ত্রিবেণী (Triveni) সঙ্গম।
সপ্তগ্রাম তৈরী সাতখানি গ্রাম নিয়ে – বাঁশবেড়িয়া, কৃষ্টপুর, বাসুদেবপুর, নিত্যানন্দপুর, শিবপুর, সাম্বাচোরা ও বলদঘাটি। সপ্তগ্রাম ও ত্রিবেণী ঘিরে একটি পৌরাণিক কাহিনী আছে। কন্নৌজের রাজা প্রিয়বান্তার সাত পুত্র ছিল –অগ্নিত্র, মেধাতিথি, বাপুষ্মান, জ্যোতিষ্মান, দ্যুতিষ্মান, সবান এবং ভাব্য। এঁরা রাজকীয় জীবনযাত্রা ও ভোগবিলাসে বিরক্ত হয়ে বেড়িয়ে পরেন এক নতুন জায়গার খোঁজে – যেখানে ওঁরা ধ্যানযোগ করতে পারেন। ঘুরতে ঘুরতে গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতীর সঙ্গমস্থলে এসে জায়গাটি এতো পছন্দ হয়ে যায় যে তপস্বীর জীবনযাপন করার জন্যে তাঁরা সাতখানি গ্রাম স্থাপন করেন। এই সপ্তগ্রামের অবস্থান বর্তমানে হুগলী জেলার মুখ্য শহর ও রেল জংশন ব্যান্ডেল থেকে মাত্র ৪ কিমি দুরত্বে। যদিও উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে – যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরে ভারতে রেল বিপ্লব ঘটেনি – তখন এখানে কয়েকটি মাত্র কুঁড়ে ঘর ছিল। কারণ এটি যে সরস্বতী নদীর তীরবর্তী বন্দর ছিল – সেই নদীটির কালের গর্ভে মজে যাওয়া এবং জব চার্নকের হাত ধরে কলকাতা বন্দরের শ্রীবৃদ্ধি
মনসামঙ্গল অনুসারে চাঁদ সওদাগর ছিলেন অধুনা আসামের কামরূপ জেলার ছয়গাও তথা তৎকালীন চম্পক নগরের প্রভাবশালী বণিক। ছয়গাও (ছয়গাঁ) ও সপ্তগ্রাম (সাতগাঁ)-এর মাঝামাঝি ব্ৰহ্মপুত্ৰের তীরবর্তী জনপদ ছিল অধুনা বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার বগুড়া – যেখানে বেহুলা ও লখিন্দরের লোহার বাসরের প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। এই রচনাটি মনসামঙ্গলের উপর নয় – কিন্তু তথ্যগুলি উল্ল্যেখ করা হল যাতে তখন নদীমাতৃক বঙ্গদেশের বানিজ্য পথগুলির একটা ধারনা করা যায়। পরিশেষে চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্যপোতের সাগরযাত্রার পথটি ছিল – সপ্তগ্রাম থেকে উজানে ত্রিবেণী সঙ্গম।
No comments:
Post a Comment