Tuesday, 13 September 2016

বারোয়ারি বলতে বোঝায় হিন্দুদের সর্বজনীন পূজা বা উৎসব। শব্দটি মূলত পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত। "বারোয়ারি" শব্দটির উৎপত্তি "বারো" (১২) ও "ইয়ার" (বন্ধু) শব্দদুটি থেকে। ১৭৯০ সালে হুগলির গুপ্তিপাড়ায় বারো জন ব্রাহ্মণ বন্ধু একটি সর্বজনীন পূজা করবেন বলে মনস্থ করেন। প্রতিবেশীদের থেকে চাঁদা তুলে আয়োজিত হয় সেই পূজা। এইভাবেই বাংলায় যে সর্বজনীন পূজানুষ্ঠানের সূচনা হয় তা লোকমুখে "বারোয়ারি পূজা" নামে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। প্রথম দিকে, দুর্গাপূজা কেবল কলকাতার ধনী বাবুদের গৃহেই আয়োজিত হত। কিন্তু বারোয়ারি পূজা চালু হওয়ার পর ব্যক্তি উদ্যোগে পূজার সংখ্যা হ্রাস পায় এবং দুর্গাপূজা একটি গণউৎসবে পরিণত হয়।
বর্তমান যুগে ‘বারোয়ারি’ শব্দটির পরিবর্তে অনেক ক্ষেত্রেই ‘সর্বজনীন’ বা ‘সার্বজনীন’ শব্দদুটি ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। বাড়ির পূজায় বহিরাগতদের প্রবেশাধিকার থাকলেও এই পূজা মূলত পারিবারিক বা ব্যক্তি উদ্যোগে হয়ে থাকে। কিন্তু বারোয়ারি পূজা পুরোটাই গণ উদ্যোগে চাঁদা তুলে করা হয়।
কলকাতার বারোয়ারি দুর্গাপূজা, বারাসত-ব্যারাকপুর অঞ্চলের বারোয়ারি কালীপূজা, কৃষ্ণনগর ও চন্দননগরের বারোয়ারি জগদ্ধাত্রী পূজা, উলুবেড়িয়া, কাটোয়া, চুঁচুড়া-বাঁশবেড়িয়া অঞ্চলের বারোয়ারি কার্তিক পূজা এবং নবদ্বীপের বারোয়ারি শাক্ত রাস উৎসব বিশেষ প্রসিদ্ধ। লক্ষ্মীপূজা, সরস্বতী পূজা ও বিশ্বকর্মা পূজায় বারোয়ারি প্রথায় অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি বাংলাদেশ রাষ্ট্রেও হিন্দুরা বারোয়ারি পূজা আয়োজন করে থাকেন।
অতীতে কোনো কারণে গুপ্তিপাড়ায় কোনো এক বাড়ির পূজায় সমাজের কিছু মানুষ অংশগ্রহণ করা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে বারো জন মিলে একটি বারোয়ারি পূজার আয়োজন করেন। বাংলা ভাষায় ইয়ার শব্দের অর্থ বন্ধু। ঠিক কত সালে এই পূজা শুরু হয়, তা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। কারো মতে, এই পূজা শুরু হয়েছিল ১৭৬১ সালে। কিন্তু অপর মতে, এই পূজার সূচনা হয় ১৭৯০ সালে।
বাড়ির পূজা
হুগলি জেলার চন্দননগর শহরের একটি ঐতিহ্যবাহী বারোয়ারি জগদ্ধাত্রী পূজা মণ্ডপের দৃশ্য। উল্লেখ্য, এই হুগলি জেলাই বারোয়ারি পূজার উৎসস্থান
বাংলায় বিভিন্ন প্রান্তে অসংখ্য বাড়িতে দুর্গাপূজা হয়ে থাকে। এই সব পূজায় জনসাধারণের জন্য অবারিত দ্বার হলেও, পূজার উদ্যোগ এবং ব্যয়নির্বাহের ক্ষেত্রে সাধারণের কোনো ভূমিকা থাকে না। পুরোটিই উদ্যোক্তা পরিবারের দ্বারা পরিচালিত হয়।
১৬১০ সাল থেকে সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার বড়িশায় তাঁদের আদি বাসভবনে দুর্গাপূজার আয়োজন করে আসছেন। এটিই সম্ভবত কলকাতার প্রাচীনতম দুর্গোৎসব। বর্তমানে এই পরিবারের সাত শরিকের বাড়িতে সাতটি দুর্গাপূজা হয়। এগুলির মধ্যে ছয়টি বড়িশায় ও একটি বিরাটিতে। বড়িশার দুর্গাপূজাগুলি হল আটচালা, বড়ো বাড়ি, মেজো বাড়ি, বেনাকি বাড়ি, কালীকিংকর ভবন ও মাঝের বাড়ি। দুর্গাপূজা ছাড়াও এই পরিবারে চণ্ডী পূজা, জগদ্ধাত্রী পূজা, দোলযাত্রা ও রথযাত্রা উৎসব হয়ে থাকে।
১৭৫৭ সালে শোভাবাজার রাজবাড়িতে নবকৃষ্ণ দেব দুর্গাপূজা শুরু করেন। তাঁর নির্দেশিত পথেই দুর্গাপূজা পরবর্তীকালে কলকাতার ধনিক বাবু সম্প্রদায়ের মর্যাদার প্রতীক হয়ে ওঠে। শাস্ত্রাচার এই সব পূজায় গৌণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। যে পূজায় যত বেশি সংখ্যক আমন্ত্রিত ইংরেজ অতিথি উপস্থিত হতেন, সেই পূজার মর্যাদা ততই বাড়ত। দেবীপ্রতিমার সম্মুখেই মুসলমান বাইজি নাচের আসর বসত। ইংরেজরা এসে নাচগান করতেন, তাঁদের জন্য উইলসন হোটেল থেকে গোরু ও শূকরের মাংস আনানো হত এবং মদ্যপানের আসরও বসত।
রানি রাসমণি এই প্রথার বিরুদ্ধে গিয়ে শুদ্ধাচারে তাঁর জানবাজারের বাড়িতে দুর্গাপূজা শুরু করেন। তিনি ইংরেজ অতিথিদের চিত্তবিনোদনের বদলে তাঁর দেশীয় প্রজাদের বিনোদনের জন্য পূজা উপলক্ষে যাত্রানুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। ১৮৬১ সালে তাঁর মৃত্যুর পর রানির জামাতাগণ নিজ নিজ বাসভবনে রানির প্রদর্শিত পথেই দুর্গাপূজার আয়োজন করতে থাকেন।
কলকাতায় আরো অনেক বাড়িতে এই ভাবে দুর্গাপূজা শুরু হয়।
বারোয়ারি দুর্গাপূজা
বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে কলকাতায় বারোয়ারি দুর্গাপূজার সূচনা ঘটে। অবশ্য কৃষ্ণনগর ও চন্দননগরে বারোয়ারি জগদ্ধাত্রী পূজা অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতেই জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। ১৯১০ সালে ভবানীপুরের বলরাম বসু ঘাট রোডে ভবানীপুর সনাতন ধর্মোৎসাহিনী সভার পক্ষ থেকে বারোয়ারি দুর্গাপূজা আয়োজিত হয়। এই পূজাটি আজও হয়ে আসছে। এরপর ১৯১১ সালে শ্যামপুকুর আদি সর্বজনীন, ১৯১৩ সালে শ্যামবাজারের শিকদারবাগান, ১৯১৯ সালে নেবুবাগান অর্থাৎ বর্তমান বাগবাজার সর্বজনীন এবং ১৯২৬ সালে সিমলা ব্যায়াম সমিতির বারোয়ারি দুর্গাপূজা শুরু হয়।

No comments:

Post a Comment