Tuesday, 27 September 2016

রত্নগর্ভা জেলা হুগলী>>ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

বীরসিংহের সিংহশিশু বিদ্যাসাগর নাম,
বাংলাদেশের ছেলে তুমি হুগলী জেলায় ধাম।  (অধুনা মেদিনীপুর )
মাতা তোমার ভগবতী ,পিতা ঠাকুরদাস ,
তুমিই মোদের গুরুর গুরু ,পুরাও মোদের আশ। 

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮২০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ সেপ্টেম্বর (বাংলা ১২২৭ বঙ্গাব্দের ১২ আশ্বিন) বর্তমান পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বীরসিংহ সেই সময় হুগলি জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ঈশ্বরচন্দ্রের পিতামহ রামজয় তর্কভূষণ ছিলেন সুপণ্ডিত ও বলিষ্ঠ দৃঢ়চেতা পুরুষ। ইনিই ঈশ্বরচন্দ্রের নামকরণ করেছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্রের পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতায় সামান্য চাকুরি করতেন। পরিবার নিয়ে শহরে বাস করা তাঁর সাধ্যের অতীত ছিল। সেই কারণে বালক ঈশ্বরচন্দ্র গ্রামেই মা ভগবতী দেবী ও ঠাকুরমার সঙ্গে বাস করতেন।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর  উনিশ শতকের বিশিষ্ট বাঙালি শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক ও গদ্যকার। তাঁর প্রকৃত নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য প্রথম জীবনেই লাভ করেন বিদ্যাসাগর উপাধি। সংস্কৃত ছাড়াও বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় বিশেষ বুৎপত্তি ছিল তাঁর। তিনিই প্রথম বাংলা লিপি সংস্কার করে তাকে যুক্তিবহ করে তোলেন ও অপরবোধ্য করে তোলেন। বাংলা গদ্যের প্রথম সার্থক রূপকার তিনিই। রচনা করেছেন জনপ্রিয় শিশুপাঠ্য বর্ণপরিচয় সহ, একাধিক পাঠ্যপুস্তক, সংস্কৃত ব্যাকরণ গ্রন্থ। সংস্কৃত, হিন্দি ও ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন সাহিত্য ও জ্ঞানবিজ্ঞান সংক্রান্ত বহু রচনা।
অন্যদিকে বিদ্যাসাগর মহাশয় ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারকও। বিধবা বিবাহ ও স্ত্রীশিক্ষার প্রচলন, বহুবিবাহ ও বাল্য বিবাহের মতো সামাজিক অভিশাপ দূরীকরণে তাঁর অক্লান্ত সংগ্রাম আজও স্মরিত হয় যথোচিত শ্রদ্ধার সঙ্গে। বাংলার নবজাগরণের এই পুরোধা ব্যক্তিত্ব দেশের আপামর জনসাধারণের কাছে পরিচিত ছিলেন ‘দয়ার সাগর’ নামে। দরিদ্র, আর্ত ও পীড়িত কখনই তাঁর দ্বার থেকে শূন্য হাতে ফিরে যেত না। এমনকি নিজের চরম অর্থসংকটের সময়ও তিনি ঋণ নিয়ে পরোপকার করেছেন। তাঁর পিতামাতার প্রতি তাঁর ঐকান্তিক ভক্তি ও বজ্রকঠিন চরিত্রবল বাংলায় প্রবাদপ্রতিম। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর মধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন প্রাচীন ঋষির প্রজ্ঞা, ইংরেজের কর্মশক্তি ও বাঙালি মায়ের হৃদয়বৃত্তি।
বাঙালি সমাজে বিদ্যাসাগর মহাশয় আজও এক প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম মেদিনীপুরে তাঁর স্মৃতিরক্ষায় স্থাপিত হয়েছে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়। রাজধানী কলকাতার আধুনিক স্থাপত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বিদ্যাসাগর সেতু তাঁরই নামে উৎসর্গিত।

Ishwarchandra Vidyasagar.jpg

জন্ম তারিখ: সেপ্টেম্বর ২৬, ১৮২০
জন্মস্থান: বীরসিংহ, তদনীন্তন হুগলি জেলা (অধুনা পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা), বাংলা প্রেসিডেন্সি (অধুনা পশ্চিমবঙ্গ), ব্রিটিশ ভারত (অধুনা  ভারত)
মৃত্যু তারিখ: জুলাই ২৯, ১৮৯১ (৭০ বছর)
মৃত্যুস্থান: কলকাতা, বাংলা প্রেসিডেন্সি (অধুনা পশ্চিমবঙ্গ), ব্রিটিশ ভারত (অধুনা  ভারত)
জীবনকাল: সেপ্টেম্বর ২৬, ১৮২০ – জুলাই ২৯, ১৮৯১
আন্দোলন: বাংলার নবজাগরণ
প্রধান স্মৃতিস্তম্ভ: বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়, বিদ্যাসাগর সেতু
ধর্ম: হিন্দু
দাম্পত্য সঙ্গী: দীনময়ী দেবী
 পিতামাতা:
সন্তান:
ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও ভগবতী দেবী
 নারায়ণচন্দ্র বিদ্যারত্ন

শিক্ষাজীবন

চার বছর নয় মাস বয়সে ঠাকুরদাস বালক ঈশ্বরচন্দ্রকে গ্রামের সনাতন বিশ্বাসের পাঠশালায় ভর্তি করে দেন। কিন্তু সনাতন বিশ্বাস বিদ্যাদানের চেয়ে শাস্তিদানেই অধিক আনন্দ পেতেন। সেই কারণে রামজয় তর্কভূষণের উদ্যোগে পার্শ্ববর্তী গ্রামের কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায় নামে এক উৎসাহী যুবক বীরসিংহে একটি নতুন পাঠশালা স্থাপন করেন। আট বছর বয়সে এই পাঠশালায় ভর্তি হন ঈশ্বরচন্দ্র। তাঁর চোখে কালীকান্ত ছিলেন আদর্শ শিক্ষক। কালীকান্তের পাঠশালায় তিনি সেকালের প্রচলিত বাংলা শিক্ষা লাভ করেছিলেন।
১৮২৮ সালের নভেম্বর মাসে পাঠশালার শিক্ষা সমাপ্ত করে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য পিতার সঙ্গে কলকাতায় আসেন। তাঁদের সঙ্গে কলকাতায় এসেছিলেন কালীকান্ত ও চাকর আনন্দরাম গুটিও। কথিত আছে, পদব্রজে মেদিনীপুর থেকে কলকাতায় আসার সময় পথের ধারে মাইলফলকে ইংরেজি সংখ্যাগুলি দেখে তিনি সেগুলি অল্প আয়াসেই আয়ত্ত করেছিলেন। কলকাতার বড়বাজার অঞ্চলের বিখ্যাত সিংহ পরিবারে তাঁরা আশ্রয় নেন। এই পরিবারের কর্তা তখন জগদ্দুর্লভ সিংহ। ১৮২৯ সালের ১ জুন সোমবার কলকাতা গভর্নমেন্ট সংস্কৃত কলেজে ব্যাকরণের তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন তিনি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই সংস্কৃত কলেজের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৮২৪ সালে; অর্থাৎ, ঈশ্বরচন্দ্রের এই কলেজে ভর্তি হওয়ার মাত্র পাঁচ বছর আগে। তাঁর বয়স তখন নয় বছর। এই কলেজে তাঁর সহপাঠী ছিলেন মুক্তারাম বিদ্যাবাগীশ ও নদিয়া-নিবাসী মদনমোহন তর্কালঙ্কার। বিদ্যাসাগরের আত্মকথা থেকে জানা যায় মোট সাড়ে তিন বছর তিনি ওই শ্রেণীতে অধ্যয়ন করেন।
ব্যাকরণ পড়ার সময় ১৮৩০ সালে সংস্কৃত কলেজের ইংরেজি শ্রেণীতেও ভর্তি হন ঈশ্বরচন্দ্র। ১৮৩১ সালের মার্চ মাসে বার্ষিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের জন্য মাসিক পাঁচ টাকা হারে বৃত্তি এবং ‘আউট স্টুডেন্ট’ হিসেবে একটি ব্যাকরণ গ্রন্থ ও আট টাকা পারিতোষিক পান। সংস্কৃত কলেজে মাসিক বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্রদের ‘পে স্টুডেন্ট’ ও অন্য ছাত্রদের ‘আউট স্টুডেন্ট’ বলা হত। অন্যদিকে তিন বছর ব্যাকরণ শ্রেণীতে পঠনপাঠনের পর বারো বছর বয়সে প্রবেশ করেন কাব্য শ্রেণীতে। সে যুগে এই শ্রেণীর শিক্ষক ছিলেন বিশিষ্ট পণ্ডিত জয়গোপাল তর্কালঙ্কার। ১৮৩৩ সালে ‘পে স্টুডেন্ট’ হিসেবেও ঈশ্বরচন্দ্র ২ টাকা পেয়েছিলেন। ১৮৩৪ সালে ইংরেজি ষষ্ঠশ্রেণীর ছাত্র ঈশ্বরচন্দ্র বার্ষিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের জন্য ৫ টাকা মূল্যের পুস্তক পারিতোষিক হিসেবে পান। এই বছরই ক্ষীরপাই নিবাসী শত্রুঘ্ন ভট্টাচার্যের কন্যা দীনময়ী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়।
১৮৩৫ সালে ইংরেজি পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র রূপে পলিটিক্যাল রিডার নং ৩ইংলিশ রিডার নং ২ পারিতোষিক পান। এই বছরই নভেম্বর মাসে সংস্কৃত কলেজ থেকে ইংরেজি শ্রেণী উঠিয়ে দেওয়া হয়। দ্বিতীয় বর্ষে সাহিত্য পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে পনেরো বছর বয়সে প্রবেশ করেন অলংকার শ্রেণীতে। অলংকার শাস্ত্র একটি অত্যন্ত কঠিন বিষয়। কিন্তু এক বছরের মধ্যেই তিনি সাহিত্য দর্পণ, কাব্যপ্রকাশরসগঙ্গাধর প্রভৃতি অলংকার গ্রন্থে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন।
১৮৩৬ সালে অলংকার পাঠ শেষ করেন। বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে রঘুবংশম্, সাহিত্য দর্পণ, কাব্যপ্রকাশ, রত্নাবলী, মালতী মাধব, উত্তর রামচরিত, মুদ্রারাক্ষস, বিক্রমোর্বশীমৃচ্ছকটিক গ্রন্থ পারিতোষিক পান। ১৮৩৭ সালের মে মাসে তাঁর ও মদনমোহনের মাসিক বৃত্তি বেড়ে হয় আট টাকা।
এই বছরই ঈশ্বরচন্দ্র স্মৃতি শ্রেণীতে ভর্তি হন। সেই যুগে স্মৃতি পড়তে হলে আগে বেদান্ত ও ন্যায়দর্শন পড়তে হত। কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্রের মেধায় সন্তুষ্ট কর্তৃপক্ষ তাঁকে সরাসরি স্মৃতি শ্রেণীতে ভর্তি নেন। এই পরীক্ষাতেও তিনি অসামান্য কৃতিত্বের সাক্ষর রাখেন এবং হিন্দু ল কমিটির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ত্রিপুরায় জেলা জজ পণ্ডিতের পদ পেয়েও পিতার অনুরোধে তা প্রত্যাখ্যান করে ভর্তি হন বেদান্ত শ্রেণীতে। শম্ভুচন্দ্র বাচস্পতি সেই সময় বেদান্তের অধ্যাপক। ১৮৩৮ সালে সমাপ্ত করেন বেদান্ত পাঠ। এই পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং মনুসংহিতা, প্রবোধ চন্দ্রোদয়, অষ্টবিংশতত্ত্ব, দত্তক চন্দ্রিকাদত্তক মীমাংসা গ্রন্থ পারিতোষিক পান। সংস্কৃতে শ্রেষ্ঠ গদ্য রচনার জন্য ১০০ টাকা পুরস্কারও পেয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। ১৮৪০-৪১ সালে ন্যায় শ্রেণীতে পঠনপাঠন করেন ঈশ্বরচন্দ্র। এই শ্রেণীতে দ্বিতীয় বার্ষিক পরীক্ষায় একাধিক বিষয়ে তিনি পারিতোষিক পান। ন্যায় পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করে ১০০ টাকা, পদ্য রচনার জন্য ১০০ টাকা, দেবনাগরী হস্তাক্ষরের জন্য ৮ টাকা ও বাংলায় কোম্পানির রেগুলেশন বিষয়ক পরীক্ষায় ২৫ টাকা – সর্বসাকুল্যে ২৩৩ টাকা পারিতোষিক পেয়েছিলেন।

বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ

জন্ম গ্রহন কালে তার পিতামহ তার বংশানু্যায়ী নাম রেখেছিলেন "ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়"। ১৮৩৯ সালের ২২ এপ্রিল হিন্দু ল কমিটির পরীক্ষা দেন ঈশ্বরচন্দ্র। এই পরীক্ষাতেও যথারীতি কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে ১৬ মে ল কমিটির কাছ থেকে যে প্রশংসাপত্রটি পান, তাতেই প্রথম তাঁর নামের সঙ্গে 'বিদ্যাসাগর' উপাধিটি ব্যবহৃত হয়। এই প্রশংসাপত্রটি ছিল নিম্নরূপ :
HINDOO LAW COMMITTEE OF EXAMINATION
We hereby certify that at an Examination held at the Presidency of Fort William on the 22nd Twenty-second April 1839 by the Committee appointed under the provisions of Regulation XI 1826 Issur Chandra Vidyasagar was found and declared to be qualified by his eminent knowledge of the Hindoo Law to hold the office of Hindoo Law officer in any of the Established Courts of Judicature.
H.T. Prinsep
President
J.W.J. Ousely
Member of the Committee of Examination
This Certificate has been granted to the said Issur Chandra Vidyasagar under the seal of the committee. This 16th Sixteenth day of May in the year 1839 Corresponding with the 3rd Third Joistha 1761 Shukavda.
J.C.C. Sutherland
Secy To the Committee
(পুরনো বানান অপরিবর্তিত)
সংস্কৃত কলেজে বারো বছর পাঁচ মাস অধ্যয়নের পর তিনি এই কলেজ থেকে অপর একটি প্রশংসাপত্র লাভ করেন। ১৮৪১ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রাপ্ত দেবনাগরী হরফে লিখিত এই সংস্কৃত প্রশংসাপত্রে কলেজের অধ্যাপকগণ ঈশ্বরচন্দ্রকে 'বিদ্যাসাগর' নামে অভিহিত করেন। প্রশংসাপত্রটি নিম্নরূপ:
অস্মাভিঃ শ্রীঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরায় প্রশংসাপত্রং দীয়তে। অসৌ কলকাতায়াং শ্রীযুত কোম্পানী সংস্থাপিত বিদ্যামন্দিরে ১২ দ্বাদশ বৎসরান্ ৫ পঞ্চমাসাংশ্চোপস্থায়াধোলিখিত শাস্ত্রান্য ধীতবান্
ব্যাকরণম্... শ্রীগঙ্গাধর শর্ম্মভিঃ
কাম্যশাস্ত্রম্... শ্রীজয়গোপাল শর্ম্মভিঃ
অলঙ্কারশাস্ত্রম্... শ্রীপ্রেমচন্দ্র শর্ম্মভিঃ
বেদান্তশাস্ত্রম্... শ্রীশম্ভুচন্দ্র শর্ম্মভিঃ
ন্যায়শাস্ত্রম্... শ্রীজয়নারায়ণ শর্ম্মভিঃ
জ্যোতিঃশাস্ত্রম্... শ্রীযোগধ্যান শর্ম্মভিঃ
ধর্মশাস্ত্রম্... শ্রীশম্ভুচন্দ্র শর্ম্মভিঃ
সুশীলতয়োপস্থিতস্বৈত স্বৈতেষু শাস্ত্রেষু সমীচীনা ব্যুৎপত্তিরজনিষ্ট।
১৭৬৩ এতচ্ছকাব্দীয় সৌরমার্গশীর্ষস্য বিংশতি দিবসীয়ম্।
Rasamoy Dutt. Secretary.
10 Decr 1841.



হুগলি জেলার মেলা >>>"মাছের মেলা"

মাছের মেলা। তবে সাগরে বা নদীতে নয়, মেলাটি বসেছে মাটির বুকেই। প্রতিবছর  পয়লা মাঘ মাছের মেলা বসে  হুগলি জেলার আদিসপ্তগ্রামে।
আদিসপ্তগ্রামের কৃষ্ণপুরে মাঘ মাসের প্রথম দিনটিতে তাই সকাল থেকেই রুই, কাতলা, ভেটকি, শোলসহ নানা মাছের পসরা সাজিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা। সপরিবারে মেলায় এসে পছন্দসই মাছ কেনেন  মানুষ। এমনকি মেলায় বসেই টাটকা রান্না করে খানও অনেকে।
এই মেলার একটা ইতিহাস রয়েছে। অনেকে বলে, মেলার বয়স আড়াই শ' বছর। আবার কারোর মতে, চার শ' বছর। তবে বয়স যা-ই হোক, শোনা যায় সমাজ সংস্কারক শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রধান শিষ্য বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী নীলাচল থেকে ফেরার পথে একদিন রাত কাটান এই কৃষ্ণপুরে। বৈষ্ণব হয়েও ওইদিন মাছের ঝোল দিয়ে পরম তৃপ্তিতে ভাত খেয়েছিলেন তিনি।
প্রাথমিকভাবে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মানুষ মাছের মেলা শুরু করলেও এখন এক দিনের এই মেলায় যান সকলেই।

হুগলি জেলার মেলা >>> "ডাবের মেলা"

পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার ব্যান্ডেলে আছে শতাব্দী প্রাচীন শ্রীশ্রী ওলাইচণ্ডী মাতার মন্দির। এখানে মায়ের শিলাময় বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত। অনেক দিন আগে এক মহিলা এই শিলার ওপর কাপড় কাচতেন, পরে মায়ের স্বপ্নাদেশে তাঁকে এই তেমাথার মোড়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়।
মা কে ঘিরে প্রতি বছর চৈত্র মাসে মেলা বসে।
হুগলির ইতিহাসে এই শতাব্দী প্রাচীন মেলা অন্যতম স্থানাধিকারী। ইতিহাসে একে "ডাবের মেলা"বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে মায়ের পূজায় অপরিহার্য অর্ঘ্য হোল ডাব। বিপুলসংখ্যক ডাব এখানে পূজায় আসে। ভক্তদের বিশ্বাস মা এখানে সকল মনকামনা পূর্ণ করেন।
জয় মা ওলাইচন্ডী।
চিত্র ও তথ্য সহায়তা :- শ্রী সৌম্য বসু, পরিক্রমণ বৃত্তান্ত এবং শ্রী তীর্থদীপ ভৌমিক।
"পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার ব্যান্ডেলে আছে শতাব্দী প্রাচীন শ্রীশ্রী ওলাইচণ্ডী মাতার মন্দির। এখানে মায়ের শিলাময় বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত। অনেক দিন আগে এক মহিলা এই শিলার ওপর কাপড় কাচতেন, পরে মায়ের স্বপ্নাদেশে তাঁকে এই তেমাথার মোড়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়।
মা কে ঘিরে প্রতি বছর চৈত্র মাসে মেলা বসে।
হুগলির ইতিহাসে এই শতাব্দী প্রাচীন মেলা অন্যতম স্থানাধিকারী। ইতিহাসে একে "ডাবের মেলা"বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে মায়ের পূজায় অপরিহার্য অর্ঘ্য হোল ডাব। বিপুলসংখ্যক ডাব এখানে পূজায় আসে। ভক্তদের বিশ্বাস মা এখানে সকল মনকামনা পূর্ণ করেন।
জয় মা চন্ডী।
চিত্র ও তথ্য সহায়তা :- সৌম্য বসু, পরিক্রমণ বৃত্তান্ত এবং তীর্থদীপ ভৌমিক।
- pritam."
"পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার ব্যান্ডেলে আছে শতাব্দী প্রাচীন শ্রীশ্রী ওলাইচণ্ডী মাতার মন্দির। এখানে মায়ের শিলাময় বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত। অনেক দিন আগে এক মহিলা এই শিলার ওপর কাপড় কাচতেন, পরে মায়ের স্বপ্নাদেশে তাঁকে এই তেমাথার মোড়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়।
মা কে ঘিরে প্রতি বছর চৈত্র মাসে মেলা বসে।
হুগলির ইতিহাসে এই শতাব্দী প্রাচীন মেলা অন্যতম স্থানাধিকারী। ইতিহাসে একে "ডাবের মেলা"বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে মায়ের পূজায় অপরিহার্য অর্ঘ্য হোল ডাব। বিপুলসংখ্যক ডাব এখানে পূজায় আসে। ভক্তদের বিশ্বাস মা এখানে সকল মনকামনা পূর্ণ করেন।
জয় মা চন্ডী।
চিত্র ও তথ্য সহায়তা :- সৌম্য বসু, পরিক্রমণ বৃত্তান্ত এবং তীর্থদীপ ভৌমিক।
- pritam."

Monday, 26 September 2016

হুগলি জেলার গান ' টপ্পা '


"ভ্রমরারে! কি মনে করি আইলে প্রাণ নলিনী ভবনে।
একি অপরূপ, সরোজে সদউ, নিদয় কেতকী কাননে।
ত্যজিয়ে এমন সুখ, দুখে আগমন, বুঝিতে না পারি নাথ, কহ কি কারণ।
অধিনীজনে কি পড়িয়াছে মনে, কি ভ্রমে আইলে এখানে।
দেখহ তপন সখা জগতে বিদিত, হেরি হই বিকসিত, থাকিলে মুদিত।
তাহার কিরণ, শেষে দহে প্রাণ, না হয় শীতল জীবনে।।"


বাংলা টপ্পার আদি পুরুষ কালী মীর্জা। ১৭৮০-৮১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি সঙ্গীত শিক্ষা শেষে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি হুগলিতে এসে বসবাস শুরু করেন। এখানেই তিনি বাংলা টপ্পা গানের চর্চা শুরু করেন। তিনি একাধারে গীতিকার, সুরকার এবং গায়ক ছিলেন। তিনি নিধুবাবুর অনেক আগে থেকে বাংলা টপ্পার প্রচলন করেন। উল্লেখ্য, ছাপরা থেকে কলকাতায় ফিরে নিধুবাবু বাংলা টপ্পা শুরু করেন ১৭৯৪ খ্রিষ্টাব্দে। সময়ের নিরিখে বাংলা টপ্পার আদি পুরুষ বলতে কালী মির্জাকে বিবেচনা করা হয়।
বাংলা টপ্পা জলপ্রিয়তা লাভ করেছিল রামনিধি গুপ্ত তথা নিধুবাবু'র সূত্রে। ১৭৭৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সরকারী রাজস্ব আদায় বিভাগে চাকরি লাভ করেন। এই বৎসরেই তিনি বিহারের ছাপরা জেলার কালেক্টর অফিসে দ্বিতীয় কেরানি হিসেবে কাজ শুরু করেন। ছাপরাতে তিনি প্রথম তিনি এক ওস্তাদের কাছে রাগ সঙ্গীতের তালিম নেওয়া শুরু করেন। পরে ছাপরা জেলার রতনপুরা গ্রামের ভিখন রামস্বামীর মন্ত্র শিষ্য হন। এই সময় তিনি উত্তরভারতের বিভিন্ন ধরনের গানের সাথে পরিচিত হয়ে উঠেন এবং বিভিন্ন সঙ্গীতশিল্পীদের কাছে রাগ সঙ্গীত শেখেন। এই সময় লক্ষ্ণৌ অঞ্চলে শোরী মিঞা'র টপ্পা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। বিভিন্ন শিল্পীদের মাধ্যমে তিনি সম্ভবত ওই টপ্পার সাথেও তাঁর পরিচয় ঘটেছিল। ১৭৯৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ছাপরা থেকে কলকাতায় ফিরে আসেন। কলকাতায় ফিরে তিনি শোভাবাজারে একটি আটচালা ঘরে সঙ্গীতের বসানো শুরু করেন। এই ঘরে প্রতিরাত্রে নিধুবাবু'র গানের আসর বসতো। এই আসরেই তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে টপ্পার সূচনা করেন তিনি। পরে এই আসরের আয়োজন হতো বাগবাজারের রসিকচাঁদ গোস্বামীর বাড়িতে। এই সকল আসরের ভিতর দিয়ে রামনিধি গুপ্ত-এর গান হয়ে যায় নিধুবাবু'র গান বা নিধুবাবু'র টপ্পা।
কালী মীর্জা এবং নিধুবাবুর পরে বাংলা টপ্পাকে সচল রাখেন শ্রীধর কথক। শ্রীধর সযত্নে কালী মীর্জা এবং নিধুবাবুর টপ্পাকে ধারণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তবে তাঁর গানে নিধুবাবুর প্রভাবই বেশি। এরপর পশ্চিমা টপ্পা শিখে বাংলা টপ্পার জগতে আসেন মহেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। সঙ্গীতে তাঁর অসাধারণ দখলের কারণে তিনি মহেশ ওস্তাদ নামে খ্যত হয়েছিলেন। মহেশচন্দ্র ১৮৫০-১৯০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তাঁর বাংলা টপ্পাকে সজীব করে রেখেছিলেন। এরপরে শ্রী রামকুমার চট্টোপাধ্য়ায় (১৯২১-২০০৯) ছিলেন টপ্পা সঙ্গীতের শেষ জনপ্রিয় গায়ক।
 উত্তর ভারতীয় সঙ্গীতে অর্ধ-শাস্ত্রীয় সঙ্গীত হিসেবে টপ্পা একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। সংস্কৃত লম্ফ শব্দ রূঢ়ারার্থে হিন্দুস্থানি সঙ্গীত গৃহীত হয়েছিল। এর অর্থ সংক্ষেপ্ত। খেয়াল বা ধ্রুপদের সংক্ষিপ্তরূপ হিসেবে হিন্দিতে 'টপা' শব্দ গৃহীত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এই শব্দটি দাঁড়ায় টপ্পা।
 টপ্পার স্বাভাবিক করুণ রস, প্রেম, প্রধানত বিরহকে বিষয়বস্ত্ত করে রচিত বলে টপ্পার উপযোগী কিছু বিশেষ রাগও আছে, যেমন - ভৈরবী, খাম্বাজ, দেশ, সিন্ধু, কালাংড়া, ঝিঁঝিট, পিলু, বারোয়া প্রভৃতি। নিধুবাবু-রচিত গানে বিরহের প্রকাশ কত মার্জিত, পরিশীলিত; একটি গানের উদাহরণ দিলে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে – >>বিধি দিলে যদি বিরহ যাতনা প্রেম গেল কেন প্রাণ গেল না হইয়ে বহিয়ে গেছে প্রেম ফুরায়েছে রহিল কেবলি প্রেমেরি নিশানা।<<
  অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে পাঞ্জাব অঞ্চলের লোকগীতি টপ্পা গানের প্রচলন শুরু হয়। প্রধানত উটের গাড়ি চালকের মুখেই টপ্পা গান বেশি শোনা যেত। শোরী মিয়া (১৭৪২-১৭৯২) নামে একজন সঙ্গীতজ্ঞ টপ্পা গানগুলোকে সাঙ্গিতিক আদর্শে সাজিয়ে সম্পূর্ণ আলাদা একটি গায়ন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। এ পদ্ধতি অনুসরণ করে রামনিধি গুপ্ত বা নিধু বাবু (১৭৪১-১৮৩৯) বাংলা টপ্পা রচনা করেন। এখানেই ভারতীয় বা হিন্দুস্থানী রাগসঙ্গীতের ধারার সঙ্গে বাংলা রাগসঙ্গীত চর্চা যুক্ত হয়। পরবর্তীতে টপ্পাকার কালীমির্জা (১৭৫০-১৮২০), বাংলা ভাষায় ধ্রুপদ রীতির প্রবর্তক রামশংকর ভট্টাচার্য (১৭৬১-১৮৫৩) এবং বাংলা ভাষায় খেয়াল রচয়িতা রঘুনাথ রায় (১৭৫০-১৮৩৬) বাংলা গানকে আরও সমৃদ্ধ করে হিন্দুস্থানী রাগসঙ্গীতের ধারার সঙ্গে যুক্ত করেন। টপ্পার উৎপত্তি কখন এবং কিভাবে শুরু হয়েছিল, তা নিয়ে নানা রকমের গল্প আছে। A.F. Strangways তাঁর Music of India গ্রন্থে– পাঞ্জাবের উট চালকদের লোকগান থেকে টপ্পার উৎপত্তি। কিন্তু অনেকেই এই কথা মানতে রাজি নন। তবে আদি টপ্পাতে পাঞ্জাবি ভাষার আধিক্য রয়েছে। এই বিচারে বলা যায়, পাঞ্জাবের লোকগীতি থেকে এই গানের সূত্রপাত ঘটেছিল। হয়তো অন্যান্য পেশার মানুষের সাথে উটচালকরা এই গান গাইতেন। কাপ্তেন উইলার্ভকে উদ্ধৃতিকে অনুসরণ করে রাজ্যেশ্বর মিত্র তাঁর বাংলার গীতিকার ও বাংলা গানের নানা দিক গ্রন্থের টপ্পার উৎস সম্পর্কে লিখেছেন– ‘টপ্পা ছিল রাজপুতনার উষ্ট্র চালকদের গীত। শোনা যায়, মধ্যপ্রাচ্য থেকে যেসব বণিক উটের পিঠে চেপে বাণিজ্য করতে আসত, তারা সারারাত নিম্নস্বরে টপ্পার মতো একপ্রকার গান গাইতে গাইতে আসত। তাদের গানের দানাদার তানকেই বলা হতো ‘জমজমা’। আসলে জমজমা শব্দে ‘দলবদ্ধ উষ্ট্র’ বোঝায়। সাধারণভাব উষ্ট্রবিহারিদের গানও এই শব্দের আওতায় এসে গেছে। লাহোরে উট বদল হতো। এই লাহোর থেকেই টপ্পার চলটি ভারতীয় সংগীতে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে।’

নিধুগুপ্তঃ- (১৭৪১-১৮৩৯)  সঙ্গীতশিল্পী ও গানের জনক। তাঁর প্রকৃত নাম ‘রামনিধি গুপ্ত’, কিন্তু সঙ্গীতজগতে তিনি ‘নিধু গুপ্ত’ নামেই পরিচিত। কেউ কেউ তাঁকে ‘নিধুবাবু’ বলেও ডাকতেন।  হুগলি জেলার চাপ্তায় মাতুলালয়ে তাঁর জন্ম। পিতা হরিনারায়ণ গুপ্ত পেশায় ছিলেন একজন কবিরাজ এবং তিনি কলকাতার কুমারটুলিতে সপরিবারে বাস করতেন।
নিধু গুপ্ত জনৈক পাদরির নিকট কিছু ইংরেজি শিক্ষার সুবাদে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অফিসে কেরানির চাকরি পান। এ উপলক্ষে তিনি ১৭৭৬ থেকে ১৭৯৪ সাল পর্যন্ত বিহারের ছাপরায় অবস্থান করেন। সেখানে একজন মুসলমান ওস্তাদের নিকট তিনি হিন্দুস্থানি টপ্পা সঙ্গীতে তালিম নেন। কোম্পানির অফিসে চাকরি করে তিনি প্রচুর অর্থের মালিক হন এবং কলকাতায় ফিরে সম্পূর্ণরূপে সঙ্গীতচর্চায় মনোনিবেশ করেন। ১৮০৮ সালে তিনি শোভাবাজারে একটি সঙ্গীত সমাজ প্রতিষ্ঠা করে তরুণদের সঙ্গীত শিক্ষা দেন।
নিধু গুপ্ত বাংলা ভাষায় টপ্পাগীতি রচনা ও সুরারোপ করে নিজেই তা গাইতেন। ক্রমে তাঁর গানের সমঝদার জোটে এবং কলকাতার নগরসমাজে তিনি অল্পদিনেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। বর্ধমানের মহারাজা তেজেশচন্দ্র রায়বাহাদুর তাঁর গানের একজন একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন।
টপ্পা প্রধানত মার্গরীতির প্রণয়গীতি; ধ্রুপদ-খেয়ালের চেয়েও সংক্ষিপ্ত আঙ্গিকে কেবল অস্থায়ী ও অন্তরা সমন্বয়ে রচিত। নিধু গুপ্ত হিন্দি টপ্পার অনুকরণে বাংলা টপ্পা রচনা করেন, তবে তাতে তাঁর স্বকীয়তা ফুটে উঠেছে। তিনি বিভিন্ন রাগের মিশ্রণ ঘটিয়ে সুরের মধ্যে বৈচিত্র্য এনেছেন। টপ্পার গায়ন-পদ্ধতি এমনই যে, এর সুরের ভাঁজে ভাঁজে গায়কের ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে। টপ্পায় বাণীর চেয়ে রাগের কাজ বেশি। এর আলাপি ধরনের সুর শ্রোতার মনে মাদকতা আনে। টপ্পাগানে আদিরসের স্থান থাকলেও নিধু গুপ্ত বিশুদ্ধ মানবীয় প্রেমের গান রচনা করেন। তিনি মাতুল সম্পর্কীয় আত্মীয় কুলুইচন্দ্রের আখড়াই গান সংশোধন করে দিতেন এবং এ গানের উন্নতিসাধনে যথেষ্ট চেষ্টাও করেন।
আখড়াই গান আদিরসাত্মক। নিধু গুপ্তের ভালোবাসার পাত্রী ছিল শ্রীমতী নামে এক রূপবতী ও সঙ্গীতনিপুণা বারাঙ্গনা। তিনি শ্রীমতীর গৃহে উপস্থিত হয়ে তাকে গান শোনাতেন এবং তার সান্নিধ্য উপভোগ করতেন। তাঁর প্রেমমূলক অনেক টপ্পার প্রেরণার মূলে ছিল এই প্রণয়পাত্রী।
স্বভাবকবির প্রতিভাগুণে নিধু গুপ্তের অনেক গান আধুনিক বাংলা লিরিকের বৈশিষ্ট্যমন্ডিত হয়েছে। ১৮৩২ সালে গীতরত্ন নামে তাঁর গানের একটি সংকলন প্রকাশিত হয়; তাতে ৯৬টি গান স্থান পায়। তাঁর পুত্র জয়গোপাল গুপ্ত ১৮৫৬ সালে এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেন; তাতে আরও সাতটি গান সংযুক্ত হয়। গীতরত্নের গানগুলির মধ্যে চারটি ভক্তিভাব ও একটি স্বদেশচেতনার গান ছাড়া বাকি ৯৮টি প্রেমবিষয়ক গান। দুর্গাদাস লাহিড়ী সম্পাদিত বাঙ্গালীর গানে (১৯০৫) নিধু গুপ্তের ৪৫০টি এবং সঙ্গীতরাগকল্পদ্রুম নামক সংকলনে ১৫০টি গান মুদ্রিত হয়েছে।
নিধু গুপ্ত বাংলা ভাষাবিষয়ক একটি গান রচনা করে স্বদেশপ্রেম ও ভাষাপ্রীতির স্বাক্ষর রেখেছেন। গানটি হলো: ‘নানান দেশের নানান ভাষা/ বিনে স্বদেশী ভাষা মিটে কি আশা\’ সেকালের প্রেক্ষাপটে এরূপ উক্তি দুর্লভ বলেই বিবেচিত হয়। ‘মনোপুর হোতে আমার হারায়েছে মন’, ‘কত ভালবাসি তারে সই, কেমনে বুঝাব’, কেমনে রহিব ঘরে মন মানে না’, ‘এমন সুখের নিশি কেন পোহাইল’ ইত্যাদি তাঁর কয়েকটি জনপ্রিয় টপ্পা গান। 
তথ্য সহায়তা ঃ- গুগল 

Sunday, 25 September 2016

ব্যান্ডেল চার্চ

ভাস্কো দা গামা ভারতের পশ্চিম উপকূলে পা রাখার প্রায় এক শতাব্দী পর পর্তুগিজরা বাংলায় প্রবেশ করা শুরু করে। দ্রুত হুগলি নদীর তীর ধরে বসতি স্থাপন শুরু হয় এবং আজ যেখানে হুগলি জেলা, সেটা পর্তুগিজদের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। ১৫৯৯ সালে হুগলি নদীর তীরে একটি গির্জা স্থাপিত হয়, সেটাই পশ্চিমবঙ্গের প্রথম গির্জা। এটিই ব্যান্ডেল চার্চ।
কিন্তু পর্তুগিজদের সুখের দিন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৬৩২ সালে মুগল সম্রাট শাহজাহান পর্তুগিজদের বসতিতে আক্রমণ করেন। সেখানে একটি ছোট দুর্গও ছিল। পর্তুগিজরা চূড়ান্ত ভাবে পরাজিত হয় এবং তাদের গির্জা ও কেল্লা ধ্বংস হয়ে যায়। বহু পর্তুগিজ এবং স্থানীয় খ্রিস্টানদের হত্যা করা হয়। ফাদার জোয়ান ডেক্রুজকে বন্দি করে আগ্রায় নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে তাঁকে একটি মত্ত হাতির সামনে ফেলে দেওয়া হয়। কিন্তু হাতিটি তাঁকে পায়ে পিষে ফেলার বদলে শুঁড়ে করে তুলে পিঠে বসিয়ে নেয়।
এই ঘটনায় সম্রাট এতই চমৎকৃত হন যে, তিনি ফাদার এবং তার অনুগামীদের মুক্তি তো দেনই পাশাপাশি নতুন করে গির্জা তৈরির জন্য করমুক্ত জমি দান করেন। আশ্চর্য ঘটনার এখানেই শেষ নয়, যুদ্ধের সময় মাতা মেরির একটি মূর্তি হুগলি নদীতে ভেসে যাচ্ছিল, সেটা উদ্ধার করতে এক স্থানীয় খ্রিস্টান জলে ঝাঁপ দিয়েছিলেন, কিন্তু সেটিকে আর উদ্ধার করা যায়নি। নতুন করে গির্জা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় সেই মূর্তিটি হঠাৎ পাড়ে ভেসে ওঠে। মূর্তিটির নাম দেওয়া হয়, ‘আওয়ার লেডি অফ দ্য হ্যাপি ভয়েজ’।
গির্জা উদ্বোধনের উদযাপন যখন চলছে, তখন একটি বিপর্যস্ত পর্তুগিজ জাহাজের পাল চোখে পড়ে সবার। জানা যায়, কিছু দিন আগেই জাহাজটি প্রবল ঝড়ের মুখে পড়েছিল। ভাগ্যক্রমে নাবিকরা জীবিত রয়েছে। ঝড়ের সময় জাহাজের ক্যাপ্টেন প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তিনি প্রথম যে গির্জাটিকে দেখবেন, সেখানে জাহাজের প্রধান মাস্তুলটি দান করবেন। ক্যাপ্টেন তাঁর কথা রেখেছিলেন। সেই মাস্তুলটি এখনও গির্জা প্রাঙ্গণে রাখা আছে। মাস্তুলকে পর্তুগিজ ভাষায় ব্যান্ডেল বলা হয়।অতএব বলাযায় এই মাস্তুলটি থেকেই বান্ডেল নামটির উৎপত্তি। সেই থেকেই এই গির্জার নাম ব্যান্ডেল চার্চ।

গির্জাটিতে একটি বিশাল ঘড়িসহ স্তম্ভ রয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এতে প্রচুর পরিবর্তন করা হয়েছে। পুরনো স্থাপত্যের কিছুই প্রায় অবশিষ্ট নেই। হুগলি নদীর তীরে একটি বেঁকানো দরজা দিয়ে গির্জায় ঢুকতে হয়। দরজার ওপরে নৌকোয় মাতা মেরি ও শিশু যিশুর মূর্তি রয়েছে। গির্জার ব্যালকনি থেকে হগলি নদীর ওপরের জুবিলি ব্রিজটি দেখা যায়।

ব্যান্ডেল চার্চ

ভাস্কো দা গামা ভারতের পশ্চিম উপকূলে পা রাখার প্রায় এক শতাব্দী পর পর্তুগিজরা বাংলায় প্রবেশ করা শুরু করে। দ্রুত হুগলি নদীর তীর ধরে বসতি স্থাপন শুরু হয় এবং আজ যেখানে হুগলি জেলা, সেটা পর্তুগিজদের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। ১৫৯৯ সালে হুগলি নদীর তীরে একটি গির্জা স্থাপিত হয়, সেটাই পশ্চিমবঙ্গের প্রথম গির্জা। এটিই ব্যান্ডেল চার্চ।
কিন্তু পর্তুগিজদের সুখের দিন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৬৩২ সালে মুগল সম্রাট শাহজাহান পর্তুগিজদের বসতিতে আক্রমণ করেন। সেখানে একটি ছোট দুর্গও ছিল। পর্তুগিজরা চূড়ান্ত ভাবে পরাজিত হয় এবং তাদের গির্জা ও কেল্লা ধ্বংস হয়ে যায়। বহু পর্তুগিজ এবং স্থানীয় খ্রিস্টানদের হত্যা করা হয়। ফাদার জোয়ান ডেক্রুজকে বন্দি করে আগ্রায় নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে তাঁকে একটি মত্ত হাতির সামনে ফেলে দেওয়া হয়। কিন্তু হাতিটি তাঁকে পায়ে পিষে ফেলার বদলে শুঁড়ে করে তুলে পিঠে বসিয়ে নেয়।
এই ঘটনায় সম্রাট এতই চমৎকৃত হন যে, তিনি ফাদার এবং তার অনুগামীদের মুক্তি তো দেনই পাশাপাশি নতুন করে গির্জা তৈরির জন্য করমুক্ত জমি দান করেন। আশ্চর্য ঘটনার এখানেই শেষ নয়, যুদ্ধের সময় মাতা মেরির একটি মূর্তি হুগলি নদীতে ভেসে যাচ্ছিল, সেটা উদ্ধার করতে এক স্থানীয় খ্রিস্টান জলে ঝাঁপ দিয়েছিলেন, কিন্তু সেটিকে আর উদ্ধার করা যায়নি। নতুন করে গির্জা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় সেই মূর্তিটি হঠাৎ পাড়ে ভেসে ওঠে। মূর্তিটির নাম দেওয়া হয়, ‘আওয়ার লেডি অফ দ্য হ্যাপি ভয়েজ’।
গির্জা উদ্বোধনের উদযাপন যখন চলছে, তখন একটি বিপর্যস্ত পর্তুগিজ জাহাজের পাল চোখে পড়ে সবার। জানা যায়, কিছু দিন আগেই জাহাজটি প্রবল ঝড়ের মুখে পড়েছিল। ভাগ্যক্রমে নাবিকরা জীবিত রয়েছে। ঝড়ের সময় জাহাজের ক্যাপ্টেন প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তিনি প্রথম যে গির্জাটিকে দেখবেন, সেখানে জাহাজের প্রধান মাস্তুলটি দান করবেন। ক্যাপ্টেন তাঁর কথা রেখেছিলেন। সেই মাস্তুলটি এখনও গির্জা প্রাঙ্গণে রাখা আছে। মাস্তুলকে পর্তুগিজ ভাষায় ব্যান্ডেল বলা হয়।অতএব বলাযায় এই মাস্তুলটি থেকেই বান্ডেল নামটির উৎপত্তি। সেই থেকেই এই গির্জার নাম ব্যান্ডেল চার্চ।

গির্জাটিতে একটি বিশাল ঘড়িসহ স্তম্ভ রয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এতে প্রচুর পরিবর্তন করা হয়েছে। পুরনো স্থাপত্যের কিছুই প্রায় অবশিষ্ট নেই। হুগলি নদীর তীরে একটি বেঁকানো দরজা দিয়ে গির্জায় ঢুকতে হয়। দরজার ওপরে নৌকোয় মাতা মেরি ও শিশু যিশুর মূর্তি রয়েছে। গির্জার ব্যালকনি থেকে হগলি নদীর ওপরের জুবিলি ব্রিজটি দেখা যায়।

Saturday, 17 September 2016

ত্রিবেনী


ত্রিবেনী, হুগলী জেলার একটি ছোট শহর. এটা হিন্দুদের একটি পুরনো পবিত্র জায়গা।
এই  স্থানের পবিত্রতা বহু শতাব্দী ধরে স্বীকৃত হয়েছে এবং Pavana-Dutam, 12th শতাব্দীর শেষ ভাগে একটি সংস্কৃত টুকরা উল্লেখ করা হয়েছে। ত্রিবেনী তিনটি নদী, যমুনা, গঙ্গা ও সরস্বতী এর সঙ্গমস্থল , সম্ভাব্য আগের নাম "Muktaveni", যা এটা প্রয়াগ, এলাহাবাদ, Yuktaveni হিসাবে পরিচিত থেকে আলাদা ছিল; "Terbonee" 1781 দ্য নদী সরস্বতী বিখ্যাত হিন্দু দাহ এলাকা, সাধারণভাবে 'শ্মশান ঘাট' নামে পরিচিত।
পশ্চিমে সপ্তগ্রাম মধ্যে দক্ষিণ দিকে. এই নদী গঙ্গা, হুগলি বা ভাগীরথী নামে পরিচিত সাগরে গিয়ে মেশে । মুকুন্দ দেব ত্রিবেনী ঘাটের কাছে মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। যমুনা, সাধারণভাবে বাংলা যমুনা আগে দক্ষিণ পূর্ব দিকে গঙ্গা থেকে বন্ধ শাখা ছিল, কিন্তু সঙ্গমস্থলে কালক্রমে সঙ্গে ভরাট হয়েছে। জাফর খান গাজীর মসজিদ "গাজীর দরগা "যদিও সেখানে প্রমাণ যে এটা সময়ের একটি আরবি কালানুক্রম, 1298 . তারিখ আরও সত্য যে ত্রিবেনী নিকটবর্তী এলাকায় বরাবর, 1267 সালে জাফর খান দখল করে বাংলার বিজয় থেকে প্রায় 60 বছর পর দ্বারা তৈরি হয়. তার প্রবেশপথ হিন্দু বৈষ্ণব ভাস্কর্য উৎকীর্ণ যা মন্দির যার উপর সম্ভবত মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল তা বলা যেতে পারে। 

ত্রিবেনী, পুরাতন কাঠামো আর্কিটেকচার ও স্থানীয়দের ধর্মীয় বিশ্বাসের কাছাকাছি থাকা জন বসতির ইতিহাস বলছে , ত্রিবেনীতেও ইউরোপীয় অধিবাসীরা ছিল যে চন্দননগরের থেকে ব্যান্ডেল পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের তুলনায় বেশি। ত্রিবেনী তে সম্ভবতঃ 16th শতকের সপ্তগ্রাম বন্দরে সরস্বতী নদী পার বাণিজ্য সম্ভাবনা খুঁজছেন সেটা পর্তুগিজ & ফরাসি বসতি বেশী গুরুত্ব আরোপ করেছে। 1536-37 সালের দিকে বাংলার রাজা কাস্টম ঘর সাতগাঁও, আজকের সপ্তগ্রামে, ছিল  প্রধান বন্দর সহ পর্তুগিজ ট্রেডিং সেন্টার।


 ঐতিহাসিকদের মতে 1579 -80 খ্রিস্টাব্দে এখানে 5000 পর্তুগীজ অধিবাসীরা ছিল।
পরবর্তীকালে মোঘল আক্রমণ,সরস্বতী নদী মজে যাওয়ায় বাণিজ্যের সম্ভাবনা কমে যাওয়া ,প্রভৃতি বিভিন্ন কারণে ইউরোপীয় বণিকদল আস্তে আস্তে ত্রিবেণী ছেড়ে হুগলী ও কলকাতা বন্দরের দিকে সরে যায় বলে মনে করা হয়। 


চিরদিনই হুগলী জেলা কৃষিতে উন্নত ছিল, যায় অঞ্ছলে প্রচুর পাট চাষ হতো, হয়তো এই কারণেই ত্রিবেণীর গঙ্গার ধরে গড়ে ওঠে বাংলার প্রথম জুট মিল। যা আজও রয়েছে।
এছাড়াও এ অঞ্চলে তৈরি হয় প্রচুর কলকারখানা, ত্রিবেণী- টিস্যুস,বান্ডেল থার্মল পাওয়ার স্টেশন,কেশোরাম রেঅন।


আগেই বলেছি ত্রিবেণী গঙ্গার ঘাটটি অতি প্রাচীন ,এটি হিন্দু দের তীর্থস্থান। মনসামঙ্গলে বর্ণিত চাঁদ সওদাগরের কাহিনীতে যে নেতি ধোপানির কথা বলা হয়েছে, সেই নেতি ধোপানির পাটাটি আজও ত্রিবেণী গঙ্গার ঘাটের পাশেই রয়েছে।
ত্রিবেণী গঙ্গার ঘাটেই রয়েছে,বেণীমাধব মন্দির,প্রাচীন শিবমন্দির,কালীতলায় ডাকাতকালীর মন্দির,পাশেই বাঁশবেড়িয়ায় হংসেশ্বরী মন্দির,ও আরো অনেক দেব দেউল। 






দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত ভারতীয় সেনার বেসমেন্ট ক্যাম্প আজও ত্রিবেণী শিবপুরে দেখাযায়। 




সপ্তগ্রাম

সপ্তগ্রাম বা সাতগাঁও ছিল মধ্যযুগীয় বাংলার একটি অন্যতম প্রধান বন্দর এবং দক্ষিণবঙ্গের প্রধান নগরী। অধুনা  হুগলি জেলায় অবস্থিত ব্যান্ডেল শহর থেকে চার কিলোমিটার দূরে এই শহর অবস্থিত ছিল। বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে এই অঞ্চলটি একটি প্রায়-গুরুত্বহীন হাট-অঞ্চলে পরিণত হয  .....পলি জমে সরস্বতী নদী মজে যাওয়ার ফলে এই বন্দর-নগরীর পতন ঘটেছিল। তবে পরবর্তীকালে কলকাতা নগরীর বিকাশ ও উত্থানে সপ্তগ্রামেরও একটি বিশেষ ভূমিকা ছিল। এইচ. ই. এ. কটন লিখেছেন, “সেই সময় এই শহরের মধ্যেই হয়ত ভবিষ্যৎ কলকাতা মহানগরীর নিউক্লিয়াস লুকিয়ে ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সাতগাঁওয়ের বিপরীত দিকের নদীতে পলি পড়ে তার ভাগ্যকেই উজ্জ্বল করে তুলেছিল।”
     
‘সপ্তগ্রাম’ শব্দটির অর্থ সাতটি গ্রাম। এই গ্রামগুলি হল বাঁশবেড়িয়া, কৃষ্টপুর, বাসুদেবপুর, নিত্যানন্দপুর, শিবপুর, সাম্বচোরা ও বলদঘাটি।
‘সপ্তগ্রাম’ নামটির বুৎপত্তি প্রসঙ্গে একটি পৌরাণিক কাহিনি প্রচলিত রয়েছে। কনৌজের রাজা প্রিয়বন্তের সাত পুত্র ছিল – অগ্নিত্র, মেধাতিথি, বপুস্মান, জ্যোতিস্মান, দ্যূতিস্মান, সবন ও ভব্য। এই সাত ভাই রাজকীয় জীবনে বিতৃষ্ণ হয়ে নিভৃতে ধ্যান করার জন্য উপযুক্ত স্থানের সন্ধানে বের হন। গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী নদীর সংগমস্থলে উপস্থিত হয়ে তাঁরা তাঁদের কাঙ্ক্ষিত স্থানের সন্ধান পান এবং সেখানকার সাতটি গ্রামে নিজ নিজ আশ্রম স্থাপন করেন। এইভাবে সেই সাতটি গ্রামকে ঘিরে গড়ে ওঠে সপ্তগ্রাম নগরী।

কলকাতার ৫০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত ত্রিবেণীতে সরস্বতী নদী হুগলি নদী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। এরপর হুগলি নদীর পশ্চিম অববাহিকায় উক্ত নদীর সমান্তরালে প্রবাহিত হয়েছে সরস্বতী। মনে করা হয়, সুদূর অতীতে সরস্বতী নদী রূপনারায়ণ নদের খাতে প্রবাহিত হত। এই রূপনারায়ণের তীরেই অবস্থিত ছিল প্রাচীন বাংলার বিখ্যাত বন্দর তাম্রলিপ্ত। সপ্তম শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে সরস্বতী নদী হুগলি নদীর দিকে তার বর্তমান খাতটিতে সরে আসতে শুরু করে। দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে সরস্বতী নদী এমন একটি অবস্থায় আসে যে অবস্থায় ত্রিবেণীতে হুগলি নদী থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরে পশ্চিমে হুগলির সমান্তরালে কিছু পথ অতিক্রম করে বর্তমান গার্ডেনরিচের অপর তীরে বেতরে পুনরায় হুগলিতে এসে পতিত হয়। এইভাবে সরস্বতী একটি চক্রাকার পথের সৃষ্টি করে। সপ্তগ্রাম বন্দর এই পথের উত্তরভাগের দক্ষিণ তটে অবস্থিত ছিল। সপ্তদশ শতাব্দীতে সরস্বতী নদী মজে যেতে শুরু করে এবং ধীরে নৌ-চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে।
বখতিয়ার খিলজি যখন বাংলায় আসেন, তখন তখন বাংলা পাঁচটি অঞ্চলে বিভক্ত ছিল – রাঢ়, বাগড়ি, বঙ্গ, বরেন্দ্র ও মিথিলা। বঙ্গ আবার বিভক্ত ছিল তিনটি অঞ্চলে – লক্ষ্মণাবতী, সুবর্ণগ্রাম ও সপ্তগ্রাম। মুঘল আমলে সপ্তগ্রাম অঞ্চলটি তিনটি প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত হয় – সাতগাঁও সরকার, সেলিমাবাদ সরকার ও মান্দারন সরকার।
       
প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে সপ্তগ্রামের বারংবার উল্লেখ থেকে এই বন্দরের খ্যাতির কথা জানা যায়। পঞ্চদশ শতাব্দীতে রচিত বিপ্রদাস পিপলাইয়ের মনসামঙ্গল কাব্যে বলা হয়েছে, চাঁদ সদাগরের বাণিজ্যতরী সপ্তগ্রাম বন্দর হয়ে সমুদ্রের পথে যেত। ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে মুকুন্দরাম লিখেছেন, সপ্তগ্রাম থেকে বণিকেরা কোথায় না যায়?
সপ্তগ্রাম বন্দরের প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানা যায় না। ১২৯৮ সালে দেবকোটের শাসক বাহরম ইৎগিন জাফর খান সপ্তগ্রাম জয় করেন। তিনি এই অঞ্চলের প্রাচীন হিন্দু ও বৌদ্ধ মন্দিরের উপাদান সংগ্রহ করে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এর থেকে অনুমিত হয় পূর্ববর্তী হিন্দু ও বৌদ্ধ যুগেও সপ্তগ্রাম এক সমৃদ্ধ নগরী ছিল। উক্ত মসজিদটি বাংলার প্রথম মসজিদ।
১৩৫০ সালে বাংলায় তুঘলক শাসনকালে (১৩৩৬–১৩৫৮) ইবন বতুতা সপ্তগ্রামে এসেছিলেন। বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায়, সপ্তগ্রামের স্থানীয় বণিকেরা বিদেশে বাণিজ্য করতে যেতেন না। কিন্তু আরব, পারস্য ও তুরস্ক থেকে বণিকেরা এখানে বাণিজ্য করতে আসতেন। ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম ভাগে পর্তুগিজ বণিকেরা সপ্তগ্রামে আসাযাওয়া করতে শুরু করেন।

১৫৩৩ সালে আলফেনসো ডে মেলো নামে এক পর্তুগিজ পাঁচটি জাহাজ ও একশো লোক নিয়ে সপ্তগ্রামে এসে উপস্থিত হন। তাঁরা সুলতানকে প্রচুর উপঢৌকন পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সব উপহারসামগ্রী আসলে ছিল চোরাই মাল। সেকথা বুঝতে পেরে খুশি হওয়ার পরিবর্তে সুলতান তাঁদের বন্দী করেন। এর পরে সংঘর্ষের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। গোয়ায় পর্তুগিজ গভর্নরের কাছে খবর পাঠানো হয়। চট্টগ্রাম বন্দরে অগ্নিসংযোগ করা হয়। ডায়ানো রেবেলো সসৈন্যে সপ্তগ্রামে উপস্থিত হন। সুলতান গিয়াসুদ্দিন মাহমুদ শাহ অবশ্য বিরোধের পথে না গিয়ে বন্দী পর্তুগিজদের মুক্তি দেন এবং তাঁদের সপ্তগ্রাম ও চট্টগ্রামে বাণিজ্য করার অনুমতি প্রদান করেন। এর পিছনে অবশ্য সুলতানের অন্য উদ্দেশ্য ছিল। তিনি আসন্ন গৃহবিবাদে পর্তুগিজদের সমর্থন পেতে চাইছিলেন।
১৫৩৫ সালের মধ্যেই পর্তুগিজরা সপ্তগ্রামে বসতি স্থাপন করে ফেলেন। শেরশাহ সপ্তগ্রাম আক্রমণ করলে পর্তুগিজরা সুলতানের পক্ষ নেন। তিনি ১৫৩৮ সালে তাঁরা সৈন্য প্রত্যাহার করে নেন। এই বছরই সুলতান গিয়াসুদ্দিন মাহমুদ শাহ পরাজিত হন। শেরশাহের মৃত্যু ও আফগান প্রাধান্যের অন্ত ঘটলে ১৫৫০ সাল নাগাদ পর্তুগিজরা আবার সপ্তগ্রামে ফিরে আসেন।
পর্যটকদের বিবরণ থেকে সপ্তগ্রাম নগরীর বাণিজ্যিক সমৃদ্ধির বিস্তারিত তথ্য জানা যায়। ভেনিসীয় পর্যটক সিজার ফ্রেডেরিক ১৫৬৩ থেকে ১৫৮১ সালের মধ্যবর্তী সময়ে প্রাচ্য ভ্রমণ করেন। তাঁর ভ্রমণবিবরণী থেকে ভারত ও বাংলার অনেক শহর ও বন্দরের বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, সপ্তগ্রাম বন্দরে ৩০-৩৫টি জাহাজে মাল তোলা হত। পর্তুগিজ পর্যটক টোমে পাইরেস বাংলায় না এলেও, তাঁর মহান কীর্তি সুমা ওরিয়েন্টাল গ্রন্থটি তাঁর ভারত ও মালাক্কা ভ্রমণের (১৫১২-১৫১৫) সময় রচিত হয়। এই গ্রন্থে সমসাময়িক বাংলার কিছু বর্ণনা পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, “এটি (সপ্তগ্রাম) ছিল একটি বড় শহর। এখানে অনেক বণিক আছেন। এই শহরে নিশ্চয়ই দশ হাজার লোক বাস করেন।” ইংরেজ পর্যটক-বণিক রালফ ফিচ লেখেন, “উত্তর আফ্রিকার শহরগুলির তুলনায় সপ্তগ্রাম রূপকথার নগরী।” ১৫৯১ সালে তিনি লন্ডনে প্রাচ্যবাণিজ্যের সম্ভাবনার কথা শুনিয়ে ঝড় তুলেছিলেন।
পর্তুগিজরা সপ্তগ্রামকে বলত Porto Pequeno বা ছোটো পোতাশ্রয় এবং চট্টগ্রামকে বলত Porto Grande মহাপোতাশ্রয়। নদীতে পলি জমে সপ্তগ্রাম প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্থ হয়। একমাত্র আদিগঙ্গার পথ ধরেই সমুদ্রগামী জাহাজ চলাচল করতে থাকে। তার উত্তরের জলপথে ছোটো নৌকা ছাড়া আর কিছুই চলাচল করতে পারে না। নদীর পশ্চিম পাড়ে বেতর গ্রামটি বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে। অনেক বণিকই সপ্তগ্রাম ছেড়ে হুগলিতে চলে আসেন। শেঠ ও বসাকেরা চলে আসেন বেতরের অপর পাড়ে গোবিন্দপুর গ্রামে। অনেক পরে সুতানুটিতে আসেন জব চার্নক। সপ্তগ্রাম বন্দরের সম্পূর্ণ পতন হলে উত্থান ঘটে কলকাতা মহানগরীর।

তথ্যসূত্র :-


  1. Cotton, H.E.A., Calcutta Old and New, 1909/1980, p. 2, General Printers and Publishers Pvt. Ltd.

  2. "Temples of Bengal"। Saptagram। hindubooks.org। সংগৃহীত ২০০৭-০৮-০৫

  3. Patree, Purnendu, Purano Kolkatar Kathachitra, (a book on History of Calcutta), (বাংলা), first published 1979, 1995 edition, pp. 65-71, Dey’s Publishing, ISBN 81-7079-751-9.

  4. Das Gupta, Siva Prasad, The Site of Calcutta: Geology and Physiography, in Calcutta, the Living City, Vol. I, p. 2, edited by Sukanta Chaudhuri, p. 17, Oxford University Press, ISBN 978-0-19-563696-3.

  5. Aniruddha Ray, and Md Akhtaruzzaman। "Satgaon"। Banglapedia। Asiatic Society of Bangladesh। সংগৃহীত ২০০৭-০৮-০৮

  6. Bandopadhyay, Rakhaldas, Banglar Itihas (History of Bengal), 1971, (বাংলা), p. 8, Naba Bharat Publishers, 72 Mahatma Gandhi Road, Kolkata.

  7. Bandopadhyay, Rakhaldas, pp. 66-67

  8. Sengupta, Somen। "Next weekend you can be at... Tribeni"। The Telegraph, 23 October 2005। সংগৃহীত ২০০৭-০৮-০৮

  9. Bandopadhyay, Rakhaldas, p. 81
    ফটো গুগল সৌজন্যে

Friday, 16 September 2016

‘রুবেন রায়’

শ্রী পুরঞ্জয় রায় বন্দ্যোপাধ্যায় সাহিত্যজগতে ‘রুবেন রায়’ ছদ্মনামে বিখ্যাত... ঠাকুর সীতারামদাস ওঙ্কারনাথের তিনি শিষ্য, পার্ষদ এবং ঠাকুরের প্রথম জীবনীকার। তাঁর রচিত কয়েকটি পঙক্তি তে ঠাকুরের প্রতি তাঁর গভীর সমর্পণ বোঝা যায়, তাঁর ভাষা যেন সকলের প্রাণের অব্যাক্ত স্বীকারোক্তি-
“আমরা আমাদের সীমিত শক্তি দিয়ে সীমাহীন দম্ভ দেখিয়েছি!
আমরা তোমার চরণপদ্মে মুঠোমুঠো কালোফুলের অর্ঘ্য উপহার দিয়েছি!
সে সব ফুল সঙ্কীর্ণতার অশুচিতার অপদার্থতার ফুল !
তুমি হাসিমুখে সব নিয়েছ, হাসিমুখেই সব সহেছ !
তবু আমরা তোমায় ভালবেসেছি,
তুমি আমাদের ভালবেসেছ।...
আমরা তোমায় অনেক বিশেষণ দিয়ে স্তবস্তুতি করেছি।
কিন্তু হায়, তোমাকে আমরা চিনিনি, তুমি আমাদের চিনেছ।
তবু আমরা তোমায় ভালবেসেছি,
তুমি আমাদের ভালবেসেছ।”

Guptipara, hooghly


Guptipara, hooghly

Sen Bati –Old zamindar house of THE Sen’s.The zamindars of Guptipara . Sribatsa Sen established their zamindari at Guptipara. Descendants of Kirti Chandra Sen organized the Durga Puja for years. The present day Durgadalan holds the 400 years old Durga Puja,the first community or Barowari Durga Puja of Bengal. The word Barowari can be split into two halves, the first half “Baro” means 12 and the second half “Yari” means friendship. According to history 12 brahmin friends inducted the first Barowari or first community Durga Puja of Bengal. It was started in the year 1790.The concept of community Durga Puja was later brought to Kolkata in the year 1832. As added by one of the present day descendants of The Sen’s. “Our age-old customs have remained unalloyed except for the inevitable changes. Goddess Durga’s advent is not seen as a brief sojourn. We treat Her as our ‘Maa’ — a real life mother, who needs to cook for her family. Therefore, all our offerings are washed, chopped and produced uncooked, the bhog is prepared only when the puja is over. Moreover, our founders were also concerned about natural habitats. We, therefore, have a permanent room atop called pyancha ghar (a room for owl) which has become a habitat of owls for years,”

Thursday, 15 September 2016

আঁটপুর


আঁটপুর হুগলি জেলার একটি গ্রাম । এটি তারকেশ্বর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত । এটি এখানে অবস্থিত অনবদ্য টেরাকোটা মন্দিরের জন্য বিখ্যাত ।
আঁটপুরের সবথেকে বিখ্যাত মন্দির হল রাধাগোবিন্দজিউ মন্দির । এটি প্রায় ১০০ ফুট উঁচু । বর্ধমান রাজের দেওয়ান কৃষ্ণরাম মিত্র এই মন্দিরটি গঠন করান । মন্দিরটি নির্মান সম্পূর্ণ হয় ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে (১৭০৮ শকাব্দে) । মন্দিরটির গায়ে অসাধারণ টেরাকোটা বা পোড়ামাটির কারুকার্য আছে । মন্দিরের ভিতের ইঁটগুলি গঙ্গামাটি ও গঙ্গাজলে তৈরি । টেরাকোটার বিষয়গুলি নেওয়া হয়েছে ১৮টি পুরান, রামায়ন, মহাভারত, ভারতের ইতিহাস এবং মন্দির গড়ার সমসাময়িক বিষয় থেকে । মন্দিরটির চণ্ডীমণ্ডপ এবং দোলমঞ্চে কাঠের কারুকার্য আছে ।
আঁটপুর রাধাগোবিন্দজিউ মন্দির
এই মন্দিরটি যে সময়ে নির্মিত হয়েছিল সে সময়ে মুসলমান রাজত্ব হ্রাস পাচ্ছিল এবং ইউরোপিয়ানদের শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছিল । এরকম বলা হয়ে থাকে যে কৃষ্ণরাম মিত্র হিন্দুদের উৎসাহ বৃদ্ধির জন্য এই মন্দিরটি নির্মান করেছিলেন । এর আগে বিষ্ণুপুরেই টেরাকোটা মন্দিরের সবচেয়ে ভালো উদাহরনগুলি ছিল । কিন্তু এই মন্দির বিষ্ণুপুরের এই গুরুত্ব খর্ব করেছিল ।
মন্দিরটির গায়ের টেরাকোটাগুলিতে ভারতের ইতিহাস পুরান এবং সর্বধর্ম সমন্বয়কে সার্থকভাবে তুলে ধরা হয়েছে । তবে রাধাকৃষ্ণ, দুর্গা ও চণ্ডী, বেশি গুরুত্ব পেয়েছে । এছাড়া যুদ্ধের বিভিন্ন দৃশ্যও স্থান পেয়েছে । যুদ্ধের টেরাকোটা ভাস্কর্যগুলিতে অশ্বারোহী, গজারোহী এবং উটারোহী সৈন্যদের দেখা যায় । এছাড়া কামান এবং বন্দুক নিয়ে সৈন্যদের টেরাকোটাও দেখা যায় । হিন্দু পুরান ও ঐতিহাসিক চরিত্রের পাশাপাশি বিভিন্ন মুসলমান বাদশা, এবং ইউরোপিয়ানদেরও তুলে ধরা হয়েছে টেরাকোটার মাধ্যমে । [১] মন্দিরটি সিল্ক রুটের উপর অবস্থিত হওয়ায় বহু সংস্কৃতির ছাপ এর উপর পড়েছে । রাধাগোবিন্দজিউয়ের মন্দিরটি কালের প্রভাবে বর্তমানে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্থ । তবুও বেশিরভাগ টেরাকোটাই এখনো ভাল অবস্থায় আছে । নিরাপত্তার কারণে বর্তমানে মন্দিরের ভিতরে প্রবেশ বন্ধ রয়েছে ।
আঁটপুর রাধাগোবিন্দজিউ মন্দিরের পোড়ামাটির কারুকার্যে মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা
রাধাগোবিন্দজিউয়ের মূল মন্দিরটি ছাড়াও এখানে রয়েছে আরো পাঁচটি শিবমন্দির । এগুলির নাম হল যথাক্রমে গঙ্গাধর, রামেশ্বর (বড়শিব), বাণেশ্বর, জলেশ্বর, ফুলেশ্বর, এছাড়া রয়েছে দোলমঞ্চ । প্রত্যেকটি শিবমন্দিরের গায়েই টেরাকোটার কারুকার্য রয়েছে ।
খড়ের ছাউনির চণ্ডীমণ্ডপ
রাধাগোবিন্দজিউয়ের মূল মন্দিরের উত্তরদিকে রয়েছে খড়ের ছাউনির চণ্ডীমণ্ডপ । এটি অসাধারণ কাঠের কাজের অন্যতম নিদর্শন । এটি প্রায় তিনশো বছরের পুরোনো এবং এর গায়ে কাঁঠাল কাঠের অসাধারণ কারুকার্য আছে । কৃষ্ণরাম মিত্রের পিতামহ কন্দর্প মিত্র এই চণ্ডীমণ্ডপে তাঁর গুরুদেবের সাথে মহামায়ার পূজা করেছিলেন ।
রাধাগোবিন্দজিউ মন্দিরের সামনে ঐতিহাসিক বকুল গাছ
এই পূজাবেদীতে এখনও শারদীয় পূজা এবং শ্যামাপূজা হয় । এই মন্দিরটির ঠিক সামনেই প্রায় পাঁচশো বছরের পুরোনো একটি বকুল গাছ আছে । গাছটি বহু ইতিহাসের সাক্ষী ।
আঁটপুরে বাবুরাম ঘোষের (যিনি পরবর্তীকালে স্বামী প্রেমানন্দ বলে পরিচিত হন) গ্রামের বাড়ি ছিল । আঁটপুরেই স্বামী বিবেকানন্দ এবং রামকৃষ্ণ পরমহংসের আরো আটজন শিষ্য ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের ২৪ ডিসেম্বর তারিখে সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিলেন । আঁটপুরে স্বামী প্রেমানন্দের জন্মস্থানের উপর রামকৃষ্ণ-প্রেমানন্দ আশ্রম গড়ে উঠেছে ।
রাজবলহাট (আঁটপুর থেকে বাসে যেতে সময় নেয় ১৫ মিনিট) হ্যান্ডলুম শাড়ির জন্য বিখ্যাত ।
কলকাতা, তারকেশ্বর বা হরিপাল থেকে সহজেই সড়কপথে আঁটপুর যাওয়া যায় । কলকাতা থেকে রেলপথে যাবার সহজ উপায় হল হাওড়া থেকে তারকেশ্বরের ট্রেন ধরে হরিপাল স্টেশনে নামা এরপর সেখান থেকে বাস । আগে আঁটপুরে একটি রেলস্টেশন ছিল । স্টেশনটি ছিল হাওড়া-আমতা-চাঁপাডাঙা-শিয়াখালা রুটের ন্যারোগেজ রেলপথের উপরে । রেলপথটি ছিল মার্টিন লাইট রেলওয়ে কম্পানির । এই কম্পানিটি ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত হয়েছিল । ১৯৫০-এর দশকে কম্পানিটি বন্ধ হয়ে যায় ।
তথ্যসূত্র
দ্য টেলিগ্রাফ ২৪ জুলাই ২০০৫
পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন বিভাগ
দ্য হিন্দু বিজনেস লাইন ২৪ জুলাই ২

Wednesday, 14 September 2016

বাঙালীর আনন্দ ও বেদনার কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়






বাঙালীর আনন্দ ও বেদনার কথাসাহিত্যিক
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (জন্মঃ- ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৮৭৬ - মৃত্যুঃ- ১৬ জানুয়ারি, ১৯৩৮ )

রেঙ্গুনে থাকাকালে ১৯১২ খ্রীষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে শরৎচন্দ্র একবার অফিসে এক মাসের ছুটি নিয়ে দেশে আসেন। এই সময় মাতুল উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের মারফত যমুনা-সম্পাদক ফণীন্দ্রনাথ পালের সঙ্গে একদিন তাঁর পরিচয় হয়। পরিচয় হলে ফণীবাবু তাঁর কাগজে লিখবার জন্য শরৎচন্দ্রকে বিশেষভাবে অনুরোধ করেন। শরৎচন্দ্র রেঙ্গুনে গিয়ে লেখা পাঠিয়ে দেবেন বলে কথা দেন।

ঐ কথা অনুযায়ী শরৎচন্দ্র রেঙ্গুনে গিয়ে তাঁর ‘রামের সুমতি’ গল্পটি পাঠিয়ে দেন। ফণীবাবু এই গল্প তাঁর কাগজে ১৩১৯ সালের ফাল্গুন ও চৈত্র সংখ্যায় প্রকাশ করেন। রামের সুমতি যমুনায় প্রকাশিত হলে শরৎচন্দ্র এক গল্প লিখেই একজন মহাশক্তিশালী লেখক হিসাবে সাহিত্যিক ও পাঠক মহলে পরিচিত হন।

ইতিপূর্বে ১৩১৪ সালে ভারতী পত্রিকায় শরৎচন্দ্রের ‘বড়দিদি’ প্রকাশিত হয়েছিল। তখন অনেকের মত রবীন্দ্রনাথও এই লেখা পড়ে শরৎচন্দ্রকে প্রতিভাবান লেখক বলে বুঝেছিলেন। বিভূতিভূষণ ভট্টর সতীর্থ সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় ভাগলপুরে শরৎচন্দ্রের লেখার খাতা থেকে ‘বড়দিদি’ নকল করে এনেছিলেন এবং পরে শরৎচন্দ্রকে না জানিয়ে এটি ভারতীতে প্রকাশ করেছিলেন।

‘রামের সুমতি’ প্রকাশিত হলে তখন নবপ্রকাশিত ভারতবর্ষ এবং সাহিত্য প্রভৃতি পত্রিকার কর্তৃপক্ষও তাঁদের কাগজের জন্য শরৎচন্দ্রের কাছে লেখা চাইতে থাকেন। শরৎচন্দ্র যমুনার সঙ্গে সঙ্গে ভারতবর্ষেও লিখতে আরম্ভ করেন। শেষে যমুনা ছেড়ে কেবল ভারতবর্ষেই লিখতে থাকেন এবং ভারতবর্ষ পত্রিকার মালিক গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্স তাঁর বইও প্রকাশ করতে শুরু করেন। যমুনা-সম্পাদক ফণী পালই অবশ্য প্রথম তাঁর ‘বড়দিদি’ উপন্যাসটি প্রকাশ করেছিলেন। ঐ সময় ফণীবাবুর বন্ধু সুধীর চন্দ্র সরকারও তাঁদের দোকান এম.সি. সরকার এন্ড সন্স থেকে শরৎচন্দ্রের পরিণীতা, পণ্ডিতমশাই প্রভৃতি কয়েকটি বই প্রকাশ করেন।



১৯১৬ খ্রীস্টাব্দের গোড়ার দিকে শরৎচন্দ্র হঠাৎ দুরারোগ্য পা-ফোলা রোগে আক্রান্ত হন। তখন তিনি স্থির করেন অফিসে এক বছরের ছুটি নিয়ে কলকাতায় এসে কবিরাজী চিকিৎসা করাবেন। অফিসে শেষ দিনে ছুটি চাইতে যাওয়ায় উপরওয়ালা সাহেবের সঙ্গে ঝগড়া হয়। ফলে শরৎচন্দ্র চাকরিতে ইস্তফা দিয়েই বরাবরের জন্য রেঙ্গুনে ছেড়ে দেশে চলে আসেন।
শরৎচন্দ্র তাঁর রেঙ্গুন-জীবনের শেষ দিকে আর মিস্ত্রীপল্লীতে থাকতেন না। এই সময় প্রথমে কিছুদিন ছিলেন ৫৭/৯ লুইস স্ট্রীটে। তারপর ছিলেন ৫৪/৩৬ স্ট্রীটে ।

শরৎচন্দ্র রেঙ্গুন থেকে সস্ত্রীক এসে প্রথমে হাওড়া শহরে ৬নং বাজে শিবপুর ফার্স্ট বাই লেনে ওঠেন। এ বাড়িতে তিনি প্রায় ৮ মাস ছিলেন। তারপর এ বাড়ি ছেড়ে তিনি পাশেই ৪নং বাজে শিবপুর ফার্স্ট বাই লেনে যান। ঐ বাড়িতে তিনি প্রায় ৯ বছর ছিলেন। তারপর এখান থেকে শিবপুর ট্রাম ডিপোর কাছে ৪৯/৪ কালীকুমার মুখার্জী লেনে গৌরীনাথ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি ভাড়া নিয়ে বছরখানেক ছিলেন। এইখানে থাকার সময়েই তিনি তাঁর দিদিদের গ্রাম হাওড়া জেলার বাগনান থানার গোবিন্দপুরের পাশেই সামতাবেড়েয় জায়গা কিনে একটা সুন্দর মাটির বাড়ি তৈরি করান। বাড়িটি একেবারেই রূপনারায়ণের গায়েই। শরৎচন্দ্র ১৯২৬ খ্রীস্টব্দের ফেব্রুয়ারী মাসে হাওড়া শহর ছেড়ে তাঁর সামতাবেড়ের বাড়িতে চলে যান।


শরৎচন্দ্রের মেজভাই প্রভাস রামকৃষ্ণ মিশনে যোগ দিয়ে সন্ন্যাসী হয়েছিলেন। সন্ন্যাস জীবনে তাঁর নাম হয়েছিল স্বামী বেদানন্দ। শরৎচন্দ্র রেঙ্গুন থেকে ফিরে ছোটভাই প্রকাশকে এনে কাছে রাখেন। পরে বিয়ে দিয়ে তাঁকে সংসারী করে দেন। প্রকাশবাবুর এক কন্যা ও এক পুত্র।

হাওড়ায় বাজে শিবপুরে থাকার সময়েই শরৎচন্দ্র তাঁর বহু গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তাই ঐ সময়টাকেই তাঁর সাহিত্যিক জীবনের স্বর্ণযুগ বলা যেতে পারে।


এই বাজে শিবপুরে থাকাকালেই ১৯২১ খ্রীস্টাব্দে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে তিনি তখন দেশবন্ধুর আহ্বানে কংগ্রেসে যোগ দেন এবং তিনি হাওড়ায় থাকতেন বলে দেশবন্ধু তাঁকে হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি করেন । ১৯২১ থেকে ১৯৩৬ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত একটানা দীর্ঘ ১৬ বছ র তিনি হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন। মাঝে ১৯২২ খ্রীস্টাব্দে তিনি একবার হাওড়া কংগ্রেসের সভাপতির পদ ত্যাগ করতে চাইলে দেশবন্ধু তা করতে দেননি।

শরৎচন্দ্র অহিংস কংগ্রসের একজন ছোটখাট নেতা হলেও বরাবরই কিন্তু ভারতের মুক্তি আন্দোলনের সশস্ত্র সংগ্রামী বা সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখতেন। বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স বা সংক্ষেপে বি ভি দলের সর্বাধিনায়ক প্রখ্যাত বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষ, কাকোরী ষড়যন্ত্র মামলার আসামী বিপ্লবী শচীন সান্যাল প্রমুখ ছাড়াও বারীন ঘোষ, উপেন বন্দোপাধ্যায়, চারু রায়, অমরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিপিন গাঙ্গুলী প্রমুখ খ্যাতনামা বিপ্লবীদের সঙ্গেও তাঁর যথেষ্ট হৃদ্যতা ছিল। বিপিনবাবু সম্পর্কে শরৎচন্দ্রের মামা হতেন। শরৎচন্দ্র বহু বিপ্লবীকে নিজের রিভলবার, বন্দুকের গুলী এবং অর্থ দিয়েও সাহায্য করতেন। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের নায়ক মহাবিপ্লবী সূর্য সেনকেও তিনি তাঁর বৈপ্লবিক কাজের জন্য অর্থ সাহায্য করেছিলেন।

শরৎচন্দ্র হাওড়ার বাজে শিবপুরে থাকার সময়েই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ পরিচয় হয়। পরিচয় হয়েছিল জোড়াসাঁকোয় রবীন্দ্রনাথের বাড়িতে বিচিত্রার আসরে। শরৎচন্দ্রের বাল্যবন্ধু ঔপন্যাসিক চারু বন্দোপাধ্যায় শরৎচন্দ্রকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে কবির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে শরৎচন্দ্র বিচিত্রার আসরে ১৩২৪ সালের ১৪ই চৈত্র তারিখে তাঁর বিলাসী গল্পটি পড়েছিলেন।

পরে নানা সূত্রে এঁদের উভয়ের মধ্যে আরও ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। শরৎচন্দ্র নানা প্রয়োজনে একাধিকবার শান্তিনিকেতনে ও জোড়াসাঁকোয় কবির কাছে গেছেন। শরৎচন্দ্র শেষ বয়সে কলকাতায় বাড়ি করলে সেখানে অনুষ্ঠিত এক সভায় কবি একবার শরৎচন্দ্রের বাড়িতেও গিয়েছিলেন।

কবির সত্তর বছর বয়সের সময় দেশবাসী যখন কলকাতার টাউন হলে তাঁকে অভিনন্দন জানায় সেই অভিনন্দন সভার বিখ্যাত মানপত্রটি রচনা করেছিলেন শরৎচন্দ্র। কবিও নিজে একবার শরৎচন্দ্রকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন।

শরৎচন্দ্র হাওড়া শহর ছেড়ে সামতাবেড়ে যখন থেকে বাস করতে থাকেন, তখন থেকে ঐ অঞ্চলের দরিদ্র লোকদের অসুখে চিকিৎসা করা তাঁর একটা কাজই হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রোগী দেখে তিনি শুধু ওষুধই দাতব্য করতেন না, অনেকের পথ্যও কিনে দিতেন। হাওড়া শহরে থাকার সময় সেখানেও তিনি এই-রকম করতেন। শরৎচন্দ্র সামতাবেড় অঞ্চলের বহু দুঃস্থ পরিবারকে বিশেষ করে অনাথ বিধবাদের মাসিক অর্থসাহায্য করতেন।

শরৎচন্দ্র সামতাবেড়ে থাকার সময় অল্প তিন-চারটি মাত্র গ্রন্থ রচনা করতে পেরেছিলেন। শরৎচন্দ্র সামতাবেড়ে থাকার সময় শেষ দিকে কলকাতার বালীগঞ্জে একটা বাড়ি তৈরি করিয়েছিলেন। এটি তৈরি হয়েছিল ১৯৩৪ খ্রীস্টাব্দে। বাড়িটি দোতালা এবং দেখতে সুন্দর। এই বাড়ির ঠিকানা হল – ২৪ অশ্বিনী দত্ত রোড।

কলকাতায় বাড়ি হলে তিনি কখন কলকাতায়, আবার কখন সামতাবেড়ে – এইভাবে কাটাতেন। কলকাতায় থাকাকালে কলকাতার তখনকার সাহিত্যিক ও শিল্পীদের দুটি নাম-করা প্রতিষ্ঠান রবিবাসর ও রসচক্রের সদস্যরা তাঁকে আমন্ত্রণ করে তাঁদের অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতেন। এঁরা কখন কখন শরৎচন্দ্রকে সম্বর্ধনাও জানিয়েছেন। রসচক্রের সদস্যরা শরৎচন্দ্রকে তাঁদের প্রতিষ্ঠানের সভাপতি করেছিলেন।

১৯৩৬ খ্রীস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শরৎচন্দ্রকে ডি.লিট. উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেন। এর আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে জগত্তারিণী পদক উপহার দিয়েছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে একবার বি.এ. পরীক্ষায় বাংলার পেপারসেটার বা প্রশ্নকর্তাও নিযুক্ত করেছিলেন। এসব ছাড়া, দেশবাসীও তাঁকে তখন ‘অপরাজেয় কথাশিল্পী,’ ‘সাহিত্য সম্রাট’ এই আখ্যায় বিভূষিত করেছিলেন। বৈদ্যবাটী যুব সংঘ, শিবপুর সাহিত্য সংসদ, যশোহর সাহিত্য সংঘ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের ও সাধারণভাবে দেশবাসীর পক্ষ থেকে একাধিকবার তাঁকে সম্বর্ধনা জানান হয়।

শরৎচন্দ্র কেবল গায়ক, বাদক, অভিনেতা ও চিকিৎসকই ছিলেন না, তাঁর চরিত্রে আরও অনেকগুলি গুণ ছিল। তাঁর চরিত্রের যে বৈশিষ্ট্যটি সবার আগে চোখে পড়ে, তা হল- মনেপ্রাণে তিনি ছিলেন একজন দরদী মানুষ। মানুষের, এমন কি জীবজন্তুর দুঃখ-দুর্দশা দেখলে বা তাদের দুঃখের কাহিনী শুনলে, তিনি অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়তেন। অনেক সময় এজন্য তাঁর চোখ দিয়ে জলও গড়িয়ে পড়ত।

পুরুষ-শাসিত সমাজে পুরুষ অপেক্ষা নারীর প্রতিই তাঁর দরদ ছিল বেশী। আবার সমাজের নিষ্ঠুর অত্যাচারে সমাজপরিত্যক্তা, লাঞ্ছিতা ও পতিতা নারীদের প্রতি তাঁর করুণা ছিল আরও বেশী। পতিতা নারীদের ভুল পথে যাওয়ার জন্য তিনি হৃদয়ে একটা বেদনাও অনুভব করতেন।

জীবজন্তুর প্রতি স্নেহবশতঃ শরৎচন্দ্র বহু বছর সি.এস.পি.সি.এ. অর্থাৎ কলকাতা পশুক্লেশ নিবারণী সমিতির হাওড়া শাখার চেয়ারম্যান ছিলেন।

এক সময় অবশ্য তিনি একজন ছোটখাট শিকারীও ছিলেন। তখন ছিপ দিয়ে মাছ ধরতে এবং বন্দুক নিয়ে পাখি শিকার করতে তিনি বিশেষ পটু ছিলেন। পরে এসব ছেড়ে দেন। তিনি বরাবরই দক্ষ সাঁতারু ছিলেন। সাপুড়েদের মত অতি অনায়াসেই বিষধর সাপও ধরতে পারতেন।

আর তিনি ছিলেন অসাধারণ অতিথিপরায়ণ, বন্ধুবৎসল পত্নীপ্রেমিক।বিলাসী না হলেও কিছুটা সৌখিন ছিলেন- বিশেষ করে বেশভূষায় ও লেখার ব্যাপারে। তিনি ঘরোয়া বৈঠকে খুব গল্প করতে পারতেন। বন্ধুদের সঙ্গে বেশ পরিহাস-রসিকতা করতেন। আত্ম-প্রচারে সর্বদাই বিমুখ ছিলেন এবং নিজের স্বার্থের জন্য কাউকে কিছু বলা কখন পছন্দ করতেন না।

জন্ম, শিক্ষা ও কর্ম

হুগলী জেলায় দেবানন্দপুর একটি ছোট্ট গ্রাম। গ্রামটি ইষ্টার্ন রেলওয়ের ব্যান্ডেল রেল স্টেশন থেকে মাইল-দুই উত্তর–পশ্চিমে অবস্থিত। এই গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে ১৮৭৬ খ্রীষ্টাব্দের ১৫ই সেপ্টেম্বর তারিখে(বাংলা ১২৮৩ সালের ৩১শে ভাদ্র) শরৎচন্দ্রের জন্ম হয়।তাঁর পিতার নাম মতিলাল চট্টোপাধ্যায় এবং মাতার নাম ভুবনমোহিনী দেবী। প্রভাসচন্দ্র ও প্রকাশচন্দ্র নামে শরৎচন্দ্রের আরও দুই ছোটভাই এবং অনিলা দেবী ও সুশীলা দেবী নামে দুই বোনও ছিলেন। অনিলা দেবী ছিলেন ভাই-বোনদের মধ্যে সবার বড় আর সুশীলা দেবী ছিলেন সবার ছোট।

শরৎচন্দ্রের পিতা মতিলাল এন্ট্রান্স পাস করে কিছুদিন এফ.এ. পড়েছিলেন। তিনি অস্থিরচিত্ত, ভবঘুরে প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তাই অল্প কিছুদিন চাকরি করা ছাড়া আর কখনও কিছুই করেন নি। গল্প-উপন্যাস লিখতেন; কিন্তু ঐ অস্থিরচিত্ততার জন্যই কোন লেখা সম্পূর্ণ করতেন না। অভাব অনটনের জন্য তিনি বেশীর ভাগ সময় স্ত্রী ও পুত্র কন্যাদের নিয়ে ভাগলপুরে শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন। তাই শরৎচন্দ্রের ছেলেবেলার অনেক গুলো বছর কেটেছিল ভাগলপুরে মামার বাড়িতে।

শরৎচন্দ্রের মাতামহ কেদারনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়ি ছিল ২৪-পরগনা জেলার হালিশহরে। কেদার বাবু ভাগলপুরে কালেকটারি অফিসের কেরানি ছিলেন। তিনি ভাগলপুরেই সপরিবারে বাস করতেন। কেদারবাবুর ছোট চার ভাই পরিবারসহ তাঁর কাছেই থাকতেন।

শরৎচন্দ্রের বয়স যখন পাঁচ বছর সেই সময় তাঁর পিতা তাঁকে গ্রামের (দেবানন্দপুরের) প্যারী পন্ডিতের (বন্দ্যোপাধ্যায়ের) পাঠশালায় ভর্তি করে দেন।শরৎচন্দ্র এখানে দু-তিন বছর পড়েন। পাঠশালার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে তিনি যেমন ছিলেন মেধাবী, তেমনি ছিলেন দুরন্ত।

শরৎচন্দ্র যখন প্যারী পন্ডিতের পাঠশালায় পড়ছিলেন, সেই সময় স্থানীয় সিদ্ধেশ্বর ভট্টাচার্য দেবানন্দপুরে একটি বাংলা স্কুল স্থাপন করেন। এই স্কুল স্থাপিত হলে শরৎচন্দ্রের পিতা শরৎচন্দ্রকে প্যারী পন্ডিতের পাঠশালা থেকে এনে সিদ্ধেশ্বর মাস্টারের স্কুলে ভর্তি করে দেন। এই স্কুলেও শরৎচন্দ্র বছর তিনেক পড়েন।

এই সময় শরৎচন্দ্রের পিতা বিহারের ডিহিরিতে একটা চাকরি পান। চাকরি পেয়ে তিনি ডিহিরিতে চলে যান। যাবার সময় তিনি স্ত্রী ও পুত্রকন্যাদের ভাগলপুরে শ্বশুরবাড়িতে রেখে যান। পরে তিনি পরিবার ডিহিরিতে নিয়ে গেলেও শরৎচন্দ্র কিন্তু পড়বার জন্য ভাগলপুরেই থেকে গেলেন। তবে ছুটিতে অবশ্য তিনি মাঝে মাঝে ডিহিরিতে বাবা মার কাছে যেতেন।
শরৎচন্দ্র দেবানন্দপুর থেকে ভাগলপুরে এলে তাঁর মাতামহ তাঁকে ভাগলপুরের দুর্গাচরণ বালক বিদ্যালয়ে ছাত্রবৃত্তি ক্লাসে ভর্তি করে দেন।ঐ ক্লাসে শরৎচন্দ্রের মাতামহের কনিষ্ঠ ভ্রাতা অঘোরনাথের জ্যেষ্ঠপুত্র মণীন্দ্রনাথও পড়তেন। সে বছরে ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে শরৎচন্দ্র এবং মণীন্দ্রনাথ উভয়েই পাস করেছিলেন।ছাত্রবৃত্তি পাস করে শরৎচন্দ্র ১৮৮৭ খ্রীষ্টাব্দে ভাগলপুরের জেলা স্কুলে সেকালের সেভেন্‌থ্‌ ক্লাসে অর্থাৎ বর্তমানের ক্লাস ফোর বা চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন।

ছাত্রবৃত্তিতে তখন ইংরাজী পড়ানো হত না। তবে বাংলা, অঙ্ক, ইতিহাস, ভূগোল প্রভৃতি বিষয় একটু বেশী করেই পড়ানো হত। শরৎচন্দ্র ছাত্রবৃত্তি পাস করার ফলে জেলা স্কুলের সেভেন্‌থ্‌ ক্লাসের বাংলা অঙ্ক ইত্যাদি তাঁর কাছে অতি তুচ্ছ বলে মনে হয়েছিল। তাঁকে কেবল ইংরাজীই যা পড়তে হত। ফলে সে বছরের শেষে পরীক্ষায় ইংরাজী এবং অন্যান্য বিষয়েও শরৎচন্দ্র এত বেশী নম্বর পেয়েছিলেন যে, শিক্ষকমশায়রা তাঁকে ডবল প্রমোশন দিয়েছিলেন। অর্থাৎ শরৎচন্দ্র ১৮৮৮ খ্রীষ্টাব্দে সেকালের সেভেন্‌থ্‌ ক্লাস থেকে সিকস্‌থ্‌ ক্লাস টপকে একেবারে ফিপ্‌থ্‌ ক্লাসে উঠেছিলেন। তখনকার দিনে স্কুলের নীচের দিক থেকে এইভাবে ক্লাস গণনা হত-নাইন্‌থ্‌ ক্লাস, এইট্‌থ্‌ ক্লাস, সেভেন্‌থ্‌ ক্লাস, সিকস্‌থ্‌ ক্লাস, ফিফ্‌থ্‌ ক্লাস, ফোরথ্‌ ক্লাস, থার্ড ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাস ও ফার্স্ট ক্লাস। ফার্স্ট ক্লাস হল বর্তমানের ক্লাস টেন বা দশম শ্রেণী।

১৮৮৯ খ্রীষ্টাব্দে শরৎচন্দ্র জেলা স্কুলের ফোরথ্‌ ক্লাসে উঠলেন, সেই সময় তাঁর পিতার ডিহিরির চাকরিটিও চলে যায়। শরৎচন্দ্রের পিতা তখন পরিবারবর্গকে নিয়ে আবার দেবানন্দপুরে ফিরে আসেন। শরৎচন্দ্র বাবা-মা’র সঙ্গে দেবানন্দপুরে এসে ঐ বছরই অর্থাৎ ১৮৮৯ খ্রীষ্টাব্দেই জুলাই মাসে হুগলী ব্রাঞ্চ স্কুলের ফোরথ্‌ ক্লাসে ভর্তি হলেন। ১৮৯২ খ্রীষ্টাব্দে শরৎচন্দ্র ফার্স্ট ক্লাসে পড়ার সময় তাঁর পিতা অভাবের জন্য আর স্কুলের মাহিনা দিতে পারলেন না, ফলে শরৎচন্দ্র পড়া ছেড়ে দিয়ে ঘরে বসে রইলেন।

শরৎচন্দ্র এই সময় সতের বছর বয়সে সর্বপ্রথম পাঠশালার সহপাঠী কাশীনাথের নাম নিয়ে ‘কাশীনাথ’ নামে একটি গল্প লেখেন। এছাড়া ‘ব্রহ্মদৈত্য’ নামে আরও একটি গল্প লিখেছিলেন। ব্রহ্মদৈত্য গল্পটি পাওয়া যায় না।

দেবানন্দপুরে মতিলালের অভাব ক্রমশ তীব্র হয়ে ওঠায় তিনি তখন বাধ্য হয়ে আবার সপরিবারে ভাগলপুরে শ্বশুরবাড়িতে গেলেন। সেটা তখন ১৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দের প্রথম দিক। শরৎচন্দ্র ভাগলপুরে গিয়েই আবার স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য প্রবল আগ্রহান্বিত হলেন। কিন্তু শরৎচন্দ্রের আগ্রহ হলে কি হবে! হুগলী ব্রাঞ্চ স্কুলের বকেয়া মাহিনা মিটিয়ে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট আনার টাকা কোথায়? ১৮৯২ খ্রীষ্টাব্দের জানুয়ারী মাসে তাঁর মাতামহের মৃত্যু হওয়ায় মামার বাড়ির একান্নবর্তী সংসার ভেঙ্গে যায়। শরৎচন্দ্রের নিজের দুই মামার মধ্যে বড়মামা ঠাকুর দাসের তখন চাকরি ছিল না। ছোটমামা বিপ্রদাস সামান্য বেতনে সেই সবে একটা চাকরিতে ঢুকেছেন। তাঁকে একাই তাঁর নিজের, তাঁর দাদা ঠাকুরদাসের এবং ভগ্নীপতি মতিলালের সংসার চালাতে হয়।

সাহিত্যিক ও সাংবাদিক পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় ঐ সময় ভাগলপুরের তেজনারায়ণ জুবিলি কলেজিয়েট স্কুলে শিক্ষকতা করতেন এবং ভাগলপুরে শরৎচন্দ্রের মামাদের প্রতিবেশী ছিলেন। পাঁচকড়িবাবুর পিতা বেণীমাধব বন্দ্যোপাধ্যায় শরৎচন্দ্রের মাতামহের বন্ধু ছিলেন। তাই শরৎচন্দ্র পাঁচকড়িবাবুকে মামা বলতেন। শরৎচন্দ্রের পড়ার আগ্রহ দেখে পাঁচকড়িবাবুই অবশেষে শরৎচন্দ্রকে তাঁদের স্কুলে ভর্তি করে নিয়েছিলেন।

শরৎচন্দ্র এই তেজনারায়ণ জুবিলি কলেজিয়েট স্কুল থেকেই পর বৎসর অর্থাৎ ১৮৯৪ খ্রীষ্টাব্দে ফেব্রুয়ারী মাসে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। পরীক্ষার আগে স্কুলে পরীক্ষার ফি এবং ঐ সঙ্গে দেয় ক’ মাসের মাহিনার টাকা জমা দেবার সময়ও শরৎচন্দ্রের ছোটমামা বিপ্রদাসকে স্থানীয় মহাজন গুলজারীলালের কাছে হ্যান্ডনোট লিখে টাকা ধার করতে হয়েছিল।

শরৎচন্দ্রের মাতামহের কনিষ্ঠ ভ্রাতা অঘোরনাথের জ্যেষ্ঠপুত্র মনীন্দ্রনাথও ঐ বছর এন্ট্রান্স পাস করেন। এন্ট্রান্স পাস করে মণীন্দ্রনাথ তেজনারায়ণ জুবিলি কলেজে ভর্তি হলেন। কিন্তু টাকার অভাবে শরৎচন্দ্রের আর ভর্তি হওয়া হল না। অভাবের জন্যই বিপ্রদাস শরৎচন্দ্রকে কলেজে ভর্তি করাতে পারলেন না।

শরৎচন্দ্রের পড়া হবে না দেখে মণীন্দ্রনাথের মা কুসুমকামিনী দেবীর বড় মায়া হল। তিনি তাঁর স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করে, তাঁদের দুই ছোট ছেলেকে পড়াবার বিনিময়ে শরৎচন্দ্রের কলেজে ভর্তি হওয়ার এবং কলেজে প্রতি মাসে মাহিনা দেওয়ার ব্যাবস্থা করে দিলেন। এর ফলে শরৎচন্দ্র কলেজে ভর্তি হতে সক্ষম হলেন। শরৎচন্দ্র রাত্রে মণীন্দ্রনাথের ছোট দু ভাই সুরেন্দ্রনাথ ও গিরীন্দ্রনাথকে পড়াতেন। এরাঁ তখন স্কুলের নীচের ক্লাসে পড়তেন। এরাঁ ছাড়া বাড়ির অন্য ছোট ছেলেরাও তাঁর কাছে অমনি পড়ত।

কলেজে পড়ার সময় শরৎচন্দ্র টাকার অভাবে কলেজের পাঠ্য বইও কিনতে পারেন নি। তিনি মণীন্দ্রনাথের এবং সহপাঠী অন্যান্য বন্ধুদের কাছ থেকে বই চেয়ে এনে রাত জেগে পড়তেন এবং সকালেই বই ফেরৎ দিয়ে আসতেন। কলেজে এইভাবে দু বছর পড়েও টেস্ট পরীক্ষার শেষে এফ.এ.পরীক্ষার ফি কুড়ি টাকা জোগাড় করতে না পারায়, শরৎচন্দ্র আর এফ.এ. পরীক্ষাই দিতে পারলেন না। ঠিক এই সময়টায় শরৎচন্দ্র অবশ্য মামার বাড়িতে ছিলেন না। কারণ ১৮৯৫ খ্রীস্টাব্দের নভেম্বর মাসে শরৎচন্দ্রের মাতার মৃত্যু হওয়ায় তার কিছুদিন পরেই শরৎচন্দ্রের পিতা মতিলাল শ্বশুরালয় ছেড়ে পুত্রকন্যাদের নিয়ে মাইল খানেক দূরে ভাগলপুরের খঞ্জরপুর পল্লীতে এসেছিলেন। এখানে মতিলাল খোলার ছাওয়া একটা মাটির ঘরে পুত্রকন্যাদের নিয়ে থাকতেন।জ্যেষ্ঠা কন্যা অনিলা দেবীর ইতিপূর্বে হাওড়া জেলায় বাগনান থানার গোবিন্দপুর গ্রামে বিয়ে হয়েছিল।অনিলা দেবী তাঁর শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন।

শরৎচন্দ্র কলেজের পড়া ছেড়ে ভাগলপুরের আদমপুর ক্লাবে মিশে অভিনয় ও খেলাধূলা করে কাটাতে লাগলেন। এবং ভাগলপুরের নির্ভীক, পরোপকারী, মহাপ্রান এক আদর্শ যুবক রাজেন মজুমদারের সঙ্গে মিশে তাঁর পরোপকারমূলক কাজের সঙ্গী হলেন। (শরৎচন্দ্র পরে তাঁর ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসে এঁকেই ইন্দ্রনাথরূপে চিত্রিত করে গেছেন) শরৎচন্দ্র এই সময় প্রতিবেশী বিভূতিভূষণ ভট্টদের বাড়িতে মিশে সেখানে নিজের একটা আস্তানা করেছিলেন এবং সেই আস্তানায় বসে দিন-রাত অজস্র গল্প-উপন্যাস লিখতেন এবং পড়তেন। শরৎচন্দ্র এই সময় মাতুল সুরেন্দ্রনাথ, গিরীন্দ্রনাথ ও উপেন্দ্রনাথ (মাতামহের তৃতীয় ভ্রতার পুত্র), এঁদের বন্ধু যোগেশচন্দ্র মজুমদার এবং প্রতিবেশী বিভূতিভূষণ ভট্ট ও তাঁর ছোট বোন নিরুপমা দেবী প্রভৃতিকে নিয়ে একটা সাহিত্য সভাও গঠন করেছিলেন। সপ্তাহে একদিন করে সাহিত্য সভার অধিবেশন হত।সেদিন সভায় সভ্যরা যে যাঁর লেখা পড়তেন। নিরুপমা দেবী সভায় যেতেন না। তিনি তাঁর দাদা বিভূতিবাবুর হাত দিয়ে লেখা পাঠিয়ে দিতেন। সাহিত্য সভার ‘ছায়া’ নামে হাতে-লেখা একটা মুখপত্রও ছিল। শরৎচন্দ্র এই সময়েই তাঁর বড়দিদি, দেবদাস, চন্দ্রনাথ, শুভদা প্রভৃতি উপন্যাস এবং অনুপমার প্রেম, আলো ও ছায়া, বোঝা, হরিচরণ প্রভৃতি গল্পগুলি রচনা করেছিলেন।

শরৎচন্দ্রের পিতা দেবানন্দপুরের ঘরবাড়ি সমস্ত বিক্রি করে এর-ওর কাছে চেয়ে চিন্তে কোন রকমে সংসার চালাতেন । শরৎচন্দ্র এই সময় বনেলী রাজ এস্টেটে অল্প কিছু-দিনের জন্য একটা চাকরি করেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ একদিন পিতার উপর অভিমান করে সব ছেড়ে নিরুদ্দেশ হন এবং সন্ন্যাসী সেজে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতে থাকেন। এই ঘুরে বেড়াবার সময় যখন তিনি মজঃফরপুরে আসেন, তখন একদিন তাঁর পিতার মৃত্যু সংবাদ জানতে পারেন।এই জেনেই তিনি ভাগলপুরে এলেন। এসে কোন রকমে পিতার শ্রাদ্ধ সম্পন্ন করে ছোটভাই-দুটিকে আত্মীয়দের কাছে এবং ছোট বোনটিকে বাড়ির মালিক মহিলাটির কাছে রেখে (শরৎচন্দ্রের ছোটমামা পরে একে নিজের কাছে নিয়ে এসেছিলেন এবং তিনিই এঁর বিয়েও দিয়েছিলেন) ভাগ্য অন্বেষণে কলকাতায় এলেন।

কলকাতায় এসে তিনি উপেন মামার দাদা কলকাতা হাইকোর্টের উকিল লালমোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে ওঠেন এবং তাঁর কাছেই ৩০ টাকা মাহিনায় হিন্দী পেপার বুকের ইংরাজী তর্জমা করার একটা চাকরি পান। শরৎচন্দ্র লালমোহনবাবুর বাড়িতে মাস-ছয়েক ছিলেন। এর পর (জানুয়ারী ১৯০৩) এখান থেকে বর্মায় চলে যান। বর্মায় গিয়ে লালমোহনবাবুর ভগ্নীপতি রেঙ্গুনের অ্যাডভোকেট অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে ওঠেন।

শরৎচন্দ্র রেঙ্গুন যাওয়ার দু-একদিন আগে কলকাতার বৌবাজারে সুরেন মামা ও গিরীন মামার সঙ্গে দেখা করতে গেলে (এঁরা দুজনেই কলকাতায় কলেজে পড়তেন) গিরীন মামার অনুরোধে বসে সঙ্গে সঙ্গেই একটা গল্প লিখে কুন্তলীন প্রতিযোগিতায় পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু গল্পটিতে নিজের নাম না দিয়ে সুরেনবাবুর নাম দিয়েছিলেন। গল্পটির নাম ‘মন্দির’। দেড়শ গল্পের মধ্যে ‘মন্দির’ সর্বশ্রেষ্ঠ বিবেচিত হয়েছিল।

শরৎচন্দ্র রেঙ্গুনে গেলে কিছুদিন পরে মেসোমশায় অঘোরবাবু বর্মা রেলওয়ের অডিট অফিসে তাঁর একটা অস্থায়ী চাকরি করে দেন। বছর দুই পরে হঠাৎ অঘোরবাবুর মৃত্যু হয়। তখন তাঁর পরিবারবর্গ রেঙ্গুন ছেড়ে দেশে চলে আসেন। এই সময় শরৎচন্দ্রের রেলের অডিট অফিসের চাকরিটিও চলে যায়। শরৎচন্দ্র তখন তাঁর রেঙ্গুনের এক বন্ধু গিরীন্দ্রনাথ সরকারের সঙ্গে পেগুতে যান। পেগু রেঙ্গুন থেকে ৪৫ মাইল উত্তরে। পেগুতে গিয়ে তিনি গিরীনবাবুর বন্ধু অবিনাশ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে অনেক দিন ছিলেন। অবিনাশবাবুর বাড়ি ছিল শরৎচন্দ্রের জন্মস্থান দেবানন্দপুরের অদূরে বৈদ্যবাটীতে। তাই অবিনাশবাবু সেই বিদেশে শরৎচন্দ্রকে নিজের দেশের লোক হিসাবে খুবই আদর-যত্নে রেখেছিলেন।

অবিনাশবাবুর বাড়িতে থাকাকালে বর্মার পাবলিক ওয়ার্কস একাউন্টস অফিসের ডেপুটি একজামিনার মণীন্দ্রকুমার মিত্রের সঙ্গে শরৎচন্দ্রের একদিন পরিচয় হয়। মণিবাবু শরৎচন্দ্রকে বেকার জেনে পরে ১৯০৬ খ্রীষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে নিজের অফিসে তাঁর একটা চাকরি করে দেন।শরৎচন্দ্র এই চাকরি পেয়েই পেগু থেকে রেঙ্গুনে চলে আসেন। এই চাকরি পাওয়ার আগে শরৎচন্দ্র মাঝে নাঙ্গলবিনে কিছুদিন এক ধানের ব্যাবসায়ীর সঙ্গে কাজ করেছিলেন। শরৎচন্দ্র মণিবাবুর দেওয়া এই চাকরিই ১৯১৬ খ্রীষ্টাব্দের এপ্রিল পর্যন্ত করেছিলেন।১৯১২-তে শরৎচন্দ্রের অফিস বর্মার একাউন্টেন্ট জেনারেল অফিসের সঙ্গে মিলিত হয়েছিল।

শরৎচন্দ্র রেঙ্গুনে থাকার সময় বেশির ভাগ সময়টাই থেকেছেন শহরের উপকণ্ঠে বোটাটং-পোজনডং অঞ্চলে। এখানে শহরের কলকারখানার মিস্ত্রীরাই প্রধানত থাকত। শরৎচন্দ্র মিস্ত্রীদের সঙ্গে অবাধে মেলামেশা করতেন। তিনি তাদের চাকরির দরখাস্ত লিখে দিতেন, বিবাদ-বিসংবাদ মিটিয়ে দিতেন, অসুখে বিনামূল্যে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করতেন, বিপদে সাহায্যও করতেন। মিস্ত্রীরা শরৎচন্দ্রকে অত্যন্ত শ্রদ্ধাভক্তি করত এবং দাদাঠাকুর বলে ডাকত। শরৎচন্দ্র এদের নিয়ে একটা সঙ্কীর্তনের দলও করেছিলেন।

শরৎচন্দ্র মিস্ত্রীপল্লীতে থাকার সময় তাঁর বাসার নীচেই চক্রবর্তী উপাধিধারী এক মিস্ত্রী থাকত। ঐ মিস্ত্রীর শান্তি নামে একটি কন্যা ছিল। চক্রবর্তী এক প্রোঢ় ও মাতাল মিস্ত্রীর সঙ্গে তার কন্যার বিয়ের ব্যাবস্থা করে। চক্রবর্তীর কন্যার কিন্তু এই বিবাহে ঘোর আপত্তি থাকে, তাই চক্রবর্তীর কন্যা একদিন তাকে ঐ বিপদে রক্ষা করবার জন্য শরৎচন্দ্রের পায়ে পড়ে তাঁকে অনুরোধ করে। তখন শরৎচন্দ্র বাধ্য হয়ে নিজেই তাকে বিয়ে করেছিলেন।

শরৎচন্দ্র স্ত্রী শান্তি দেবীকে নিয়ে বেশ সুখেই ছিলেন। তাঁদের একটি পুত্রও হয়। পুত্রের বয়স যখন এক বৎসর, সেই সময় রেঙ্গুনেই প্লেগে আক্রান্ত হয়ে শান্তি দেবী এবং শিশুপুত্র উভয়েরই মৃত্যু হয়। স্ত্রী ও পুত্রকে হারিয়ে শরৎচন্দ্র তখন গভীর শোকাহত হয়েছিলেন।

শান্তি দেবীর মৃত্যুর অনেকদিন পরে শরৎচন্দ্র ঐ রেঙ্গুনেই দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন। বিবাহের সময় পর্যন্ত শরৎচন্দ্রের এই দ্বিতীয়া স্ত্রীর নাম ছিল মোক্ষদা। বিবাহের পর শরৎচন্দ্র তাঁর মোক্ষদা নাম বদলে হিরণ্ময়ী নাম দিয়েছিলেন এবং তখন থেকে তাঁর এই নামই প্রচলিত হয়। বিয়ের সময় হিরণ্ময়ী দেবীর বয়স ছিল ১৪।

হিরণ্ময়ী দেবীর বাবার নাম কৃষ্ণদাস অধিকারী। তাঁর মূল বাড়ি মেদনীপুর জেলায় শালবনীর নিকটে শ্যামচাঁদপুর গ্রামে। কৃষ্ণবাবু তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর পর আট বছরের কনিষ্ঠা কন্যা মোক্ষদাকে সঙ্গে নিয়ে ভাগ্যান্বেষণে এক মিস্ত্রী বন্ধুর কাছে রেঙ্গুনে এসেছিলেন। তাঁর পুত্র ছিল না। ক্ষীরোদা, সুখদা ও অপর একটি কন্যার আগেই বিয়ে দিয়েছিলেন।

হিরণ্ময়ী দেবী যখন রেঙ্গুনের মিস্ত্রীপল্লীতে তাঁর বাবার কাছে থাকতেন, সেই সময় শরৎচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর বাবার বিশেষ পরিচয় হয়। এই বিশেষ পরিচয়ের জোরেই হিরণ্ময়ী দেবীর বাবা একদিন সকালে কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে শরৎচন্দ্রকে অনুরোধ করে করে বলেন-আমার মেয়েটির এখন বিয়ের বয়স হয়েছে। একে সঙ্গে নিয়ে একা বিদেশ বিভুঁইয়ে কোথায় থাকি! আপনি যদি অনুগ্রহপূর্বক আমার এই কন্যাটিকে গ্রহন করে আমায় দায়মুক্ত করেন তো বড় উপকার হয়। আর একান্তই যদি না নিতে চান তো, আমায় কিছু টাকা দিন। আমি মেয়েকে নিয়ে দেশে ফিরে যাই। দেশে গিয়ে মেয়ের বিয়ে দিই।

কৃষ্ণবাবু শেষে শরৎচন্দ্রের কাছে টাকার কথা বললেও, তিনি বিশেষ করে শরৎচন্দ্রকে অনুরোধ করেন, যেন তিনিই তাঁর কন্যাটিকে গ্রহণ করেন।

শরৎচন্দ্র প্রথমে অরাজী হলেও কৃষ্ণবাবুর অনুরোধে শেষ পর্যন্ত তাঁর কন্যাকে বিয়ে করেন।
হিরণ্ময়ী দেবী নিঃসন্তান ছিলেন। বিয়ের সময় পর্যন্ত হিরণ্ময়ী দেবী লেখাপড়া জানতেন না। পরে শরৎচন্দ্র তাঁকে লিখতে ও পড়তে শিখিয়েছিলেন। হিরণ্ময়ী দেবী ছেলেবেলা থেকেই শান্তস্বভাবা, সেবাপরায়ন ও ধর্মশীলা ছিলেন। শরৎচন্দ্র তাঁকে নিয়ে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সুখে শান্তিতেই কাটিয়ে গেছেন।

শরৎচন্দ্র রেঙ্গুনে চাকরি করার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে প্রচুর পড়াশুনা, গান-বাজনা এবং সাহিত্য-চর্চাও করতেন। প্রথম দিকে অনেক দিন ছবিও এঁকেছেন। মিস্ত্রী-পল্লীতে বোটাটং-এর ল্যান্সডাউন স্ট্রীটে যখন তিনি একটা কাঠের বাড়ির দুতলায় থাকতেন, সেই সময় ১৯১২ খ্রীষ্টাব্দের ৫ই ফেব্রুয়ারী তারিখে তাঁর বাসার নীচের তলায় আগুন লাগে। সেই আগুনে তাঁর কয়েটি বইয়ের পান্ডুলিপি, কিছু অয়েল পেন্টিং এবং এক সাহেবের কাছ থেকে কেনা একটি লাইব্রেরী-সমেত তাঁর বাসাটিও পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

শরৎচন্দ্রের জীবনের শেষ ক’বছর শরীর আদৌ ভাল যাচ্ছিল না। একটা-না-একটা রোগে ভুগছিলেনই। ১৯৩৭ খ্রীস্টাব্দের গোড়ার দিকে তিনি কিছুদিন জ্বরে ভোগেন। জ্বর ছাড়লে ডাক্তারের উপদেশে দেওঘর বেড়াতে যান। সেখানে তিন-চার মাস থাকেন।

দেওঘর থেকে এসে কিছুদিন সুস্থ থাকার পর শরৎচন্দ্র সেপ্টেম্বর মাসে আবার অসুখে পড়লেন। এবার তাঁর পাকাশয়ের পীড়া দেখা দেয় এবং দেখতে দেখতে এই রোগ ক্রমেই বেড়ে যেতে লাগল। যা খান আদৌ হজম হয় না। তার উপর পেটেও যন্ত্রণা দেখা দেয়।

শরৎচন্দ্র এই সময় সামতাবেড়ে গ্রামের বাড়িতে থাকতেন।চিকিৎসা করাবার জন্য কলকাতার বাড়িতে এলেন। কলকাতায় ডাক্তাররা এক্স-রে করে দেখলেন, শরৎচন্দ্রের যকৃতে ক্যানসার তো হয়েছেই, অধিকন্তু এই ব্যাধি তাঁর পাকস্থলীও আক্রমণ করেছে।

এই সময় শরৎচন্দ্র একটি উইল করেন। উইলে তিনি তাঁর যাবতীয় স্থাবর ও অস্থাবর সম্পতি স্ত্রী হিরণ্ময়ী দেবীকে জীবনস্তত্বে দান করেন। হিরণ্ময়ী দেবীর মৃত্যর পর কনিষ্ঠ ভ্রাতা প্রকাশচন্দ্রের পুত্র বা পুত্ররা সমস্থ সম্পতির অধিকারী হবেন, উইলে এ কথাও লেখা হয়।(হিরণ্ময়ী দেবী তাঁর স্বামীর মৃত্যর পর প্রায় ২৩ বছর বেঁচে ছিলেন। তাঁর মৃত্য তারিখ ১৫ই ভাদ্র, ১৩৬৭।)

কলকাতার তৎকালীন শ্রেষ্ঠ চিকিৎসকগন-ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়, ডাঃ কুমুদশঙ্কর রায় প্রভৃতি শরৎচন্দ্রকে দেখে স্থির করলেন যে, শরৎচন্দ্রের পেটে অস্ত্রোপচার ছাড়া আর কোন উপায় নেই।

ডাঃ ম্যাকে সাহেবের সুপারিশে শরৎচন্দ্রের চিকিৎসার জন্য তাঁকে বাড়ি থেকে দক্ষিণ কলকাতার ৫নং সুবার্বন হস্‌পিটাল রোডে একটি ইউরোপীয় নার্সিং হোমে নিয়ে যাওয়া হল। কিন্তু এখানে শরৎচন্দ্রকে তাঁর নেশার জিনিস সিগারেট খেতে না দেওয়ায়, তিনি কষ্ট বোধ করতে লাগলেন।

এই নার্সিং হোমে সকালে ও বিকালে দেখা করবার নির্দিষ্ট সময় ছাড়া অন্য সময় কাকেও শরৎচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে দিত না। তাছাড়া ইউরোপীয় নার্সরা এদেশীয় লোক বলে শরৎচন্দ্রের সঙ্গে নাকি ভাল ব্যাবহার করতেন না। এই সব কারনে শরৎচন্দ্র দুদিন পরে সেখান থেকে চলে এসে তাঁর দূর সম্পর্কীয় আত্মীয় ডাঃ সুশীল চ্যাটার্জীর ৪ নং ভিক্টোরিয়া টেরাসে অবস্থিত ‘পার্ক নার্সিং হোমে’ ভর্তি হলেন।

শরৎচন্দ্রের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সংবাদ শুনে রবীন্দ্রনাথ তখন এক পত্রে লিখেছিলেন-
কল্যাণীয়েষু, শরৎ, রুগ্ন, দেহ নিয়ে তোমাকে হাসপাতালে আশ্রয় নিতে হয়েছে শুনে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হলুম। তোমার আরোগ্য লাভের প্রত্যাশায় বাংলা দেশ উৎকণ্ঠিত হয়ে থাকবে। ইতি ৩১।১২।৩৭

সেই সময়কার বিখ্যাত সার্জন ললিতমোহন বন্দোপাধ্যায় শরৎচন্দ্রের পেটে অপারেশন করেছিলেন।
অপারেশন করেও শরৎচন্দ্রকে বাঁচানো সম্ভব হল না।
অপারেশন হয়েছিল ১২।১।৩৮ তারিখে। এর পর শরৎচন্দ্র মাত্র আর চারদিন বেঁচে ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর দিনটা ছিল রবিবার, ১৯৩৮ খ্রীষ্টাব্দের ১৬ই জানুয়ারী(বাংলা ১৩৪৪ সালের ২রা মাঘ)। এই দিনই বেলা দশটা দশ মিনিটের সময় শরৎচন্দ্র সকলের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ৬১ বৎসর ৪ মাস।
 উপন্যাস :
বড়দিদি, ১৯১৩
বিরাজবৌ, ১৯১৪
পন্ডিতমশাই, ১৯১৪
পল্লী-সমাজ, ১৯১৬
চন্দ্রনাথ, ১৯১৬
শ্রীকান্ত-প্রথম পর্ব, ১৯১৭
দেবদাস, ১৯১৭
চরিত্রহীন, ১৯১৭
দত্তা, ১৯১৮
শ্রীকান্ত-দ্বিতীয় পর্ব, ১৯১৮
গৃহদাহ, ১৯২০
বামুনের মেয়ে, ১৯২০
দেনা পাওনা, ১৯২৩
নব-বিধান, ১৯২৪
পথের দাবী, ১৯২৬
শ্রীকান্ত-তৃতীয় পর্ব, ১৯২৭
শেষ প্রশ্ন, ১৯৩১
শ্রীকান্ত-চতুর্থ পর্ব, ১৯৩৩
বিপ্রদাস, ১৯৩৫
শুভদা, ১৯৩৮
নাটক :
ষোড়শী, ১৯২৮
রমা, ১৯২৮
বিরাজ বৌ, ১৯৩৪
বিজয়া, ১৯৩৫
গল্প :
রামের সুমতি ১৯১৪
পরিণীতা, ১৯১৪
বিন্দুর ছেলে, ১৯১৪
পথ-নির্দেশ, ১৯১৪
মেজদিদি, ১৯১৫
আধাঁরে আলো ১৯১৫
দর্পচূর্ণ ১৯১৫
বৈকুণ্ঠের উইল, ১৯১৬
অরক্ষণীয়া, ১৯১৬
নিষ্কৃতি, ১৯১৭
কাশীনাথ, ১৯১৭
স্বামী, ১৯১৭
ছবি, ১৯২০
বিলাসী, ১৯২০
মামলার ফল, ১৯২০
হরিলক্ষী, ১৯২৬
মহেশ, ১৯২৬
অভাগীর স্বর্গ, ১৯২৬
অনুরাধা, ১৯৩৪
সতী, ১৯৩৪
পরেশ, ১৯৩৪
প্রবন্ধ :
নারীর মূল্য
তরুণের বিদ্রোহ, ১৯১৯
স্বদেশ ও সাহিত্য, ১৯৩২
স্বরাজ সাধনায় নারী
শিক্ষার বিরোধ
স্মৃতিকথা
অভিনন্দন
ভবিষ্যৎ বঙ্গ-সাহিত্য
গুরু-শিষ্য সংবাদ
সাহিত্য ও নীতি
সাহিত্যে আর্ট ও দুর্নীতি
ভারতীয় উচ্চ সঙ্গীত
চলচ্চিত্রায়ণ :
তাঁর সাহিত্য-কর্মকে ঘিরে ভারতীয় উপমহাদেশে এ পর্যন্ত প্রায় পঞ্চাশটি চলচ্চিত্র বিভিন্ন ভাষায় তৈরী হয়েছে। তন্মধ্যে - দেবদাস উপন্যাসটি বাংলা, হিন্দি এবং তেলেগু ভাষায় আটবার তৈরী হয়। পরিণীতা দুইবার, ঋষিকেশ মুখার্জী'র মাঝলি দিদি অন্যতম। স্বামী (১৯৭৭) চলচ্চিত্রের জন্য ফিল্মফেয়ার সেরা লেখকের পুরস্কার পান। বিন্দুর ছেলে অবলম্বনে ছোটি বহু (১৯৭১) নামে খ্যাতনামা চলচ্চিত্র তৈরী হয়। ১৯৭৬ সালে দত্তা চলচ্চিত্রে সুচিত্রা সেন এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এছাড়া তার নববিধান উপন্যাসের ছায়া অবলম্বনে ২০১৩ সালে তুমহারি পাখি নামক একটি ভারতীয় টিভি ধারাবাহিক নির্মিত হয়|
(সৌজন্যে:উইকিপিডিয়া)