ঔঁ সর্ব মঙ্গলা মঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থ সাধিকে শরণ্যে ত্রম্বকে গৌরি নারায়ণী নমোহস্তুতে।।
আজ থেকে প্রায় ১০০০ বছর আগের কথা, ভাগীরথীর পূর্বপাড়ে বাস করতেন এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ। পারিবারিক অশান্তির কারণে তাঁর জীবন সম্পর্কে বিতৃষ্ণা জন্মায় ,এবং আত্মাহুতি দেবার বাসনায় ভোট গঙ্গায় ঝাঁপ দেন। ভরা বর্ষায় ভাগীরথীর উন্মত্ত স্রোতে তাঁর অচেতন দেহ ভাসতে ভাসতে পশ্চিম পাড়ের গহীন জঙ্গলে ঘেরা এক বটগাছের নিচে এসে পৌঁছায় ,............তখন মাঝরাত, কিছুক্ষন পরে তিনি ক্লান্ত পরিশ্রান্ত অবস্থায় সেই বটগাছের নীচে ঘুমিয়ে পড়েন।নিদ্রিত অবস্থায় তিনি স্বপ্নে দেখেন, ঘোর কৃষ্ণবর্ণা এক অপরূপ সুন্দরী মাতৃমূর্তি তাঁকে বলছেন," 'তুই কোথায় যাচ্ছিস? তোর যে এখনো অনেক কাজ বাকি, পাড়ে উঠে দেখ , ওখানে আছে কেলে ডাকাতের পাট , ও পঞ্চমুণ্ডীর আসন , একসময় আমি এখানে পূজিতা হতাম , তুই ওখানে আমার মন্দির প্রতিষ্ঠা কর, তোর মঙ্গল হবে। এটা বলয়পপীঠ," (হিন্দু শাস্ত্র মতে দক্ষযজ্ঞের পর মহাদেব তাঁর স্ত্রী সতীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে বিশ্ব পরিভ্রমনে বের হন , তখন অন্যান্য দেবতাদের অনুরোধে বিষ্ণু তাঁর সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ খন্ড খন্ড করে দেন। মাতা সতীর দেহাংশ যেখানে যেখানে পড়েছিল সেগুলি হলো শক্তিপীঠ , আর সতীমায়ের পরিধেয় গহনা যেখানে যেখানে পড়েছিল সেগুলি হলো উপপীঠ। বলয়পপীঠ মানে সতীমায়ের হাতের বলয় বা বালা ) ..........
তখন ভোর হতে চলেছে,ঘুম ভেঙে উঠে ব্রাম্হন ভাবলেন,দীর্ঘ পরিশ্রমের ক্লান্তিতে বোধহয় এ রকম স্বপ্ন দেখলাম ,.......যায় হোক তিনি ক্লান্ত শরীর নিয়ে ধীরে ধীরে পাড়ে উঠলেন,গহীন বনের মধ্যে একটি বেলগাছ দেখতে পেলেন,ক্লান্তিতে আবার বেলতলায় ঘুমিয়ে পড়লেন।
নিদ্রিত অবস্থায় আবার স্বপ্ন দেখলেন ,মা বলছেন,"তুই আমার পূজার ব্যবস্থা কর " তখন বিকেল হতে চলেছে, ঘুম ভেঙে ব্রাহ্মণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কিছুক্ষন ইতস্তত ঘুরে বেরিয়ে আবার বেলতলায় এসে বসে পড়লেন , মনের মধ্যে সংশয়, পারিবারিক অশান্তির দুঃখ, অভিমান সব মিলেমিশে একাকার ,..................
সেই ব্রাম্হনের পদবি ছিল মুখোপাধ্যায়। রাত নেমে এল,অনাহারে ক্লান্তিতে অবসন্ন দেহে গঙ্গার পাড়ে গহীন জঙ্গলের মধ্যে সেই বেলতলায় তিনি আবার ঘুমিয়ে পড়লেন। স্বপ্নে আবার মা এলেন, আবার ব্রাম্হন বললেন, 'মা গো ,তোমাকে পুজো করার সামর্থ আমার কোথায়?নিঃসম্বল অবস্থায় মা গঙ্গার বুকে স্থান চেয়েছিলাম,মা স্থান না দিয়ে এখানে ঠেলে দিলেন,এটা কোথায় আমি জানি না, এই জঙ্গলে জনপ্রাণীর দেখা পায়নি, ২ দিন অনাহারে আছি , আমি কিভাবে তোমার পুজো করবো মা ?' উত্তরে মা বললেন",আয়োজনের জন্য চিন্তা করিস না,পুজোর আয়োজনের ব্যবস্থা আমিই করে দেব " , ব্রাম্হনের ঘুম ভেঙে গেল , তখন ভোরের পাখিরা ডাকছে,............
সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে তিনি উঠে বেলতলাটা সুন্দরভাবে পরিষ্কার করলেন, তারপর ভাগিরথীতে স্নানে নামলেন।ভরা বর্ষায় ভাগীরথীর ভাবগম্ভীর সৌন্দর্য্যে তিনি মুগ্ধ ও অবিভূত হলেন। স্নান করতে করতে চিন্তা করলেন 'আমি সংসারী মানুষ,হঠাৎ করে আমার মনে যে গভীর ভক্তিভাবের উদয় হলো ,তা কি কেবল দেবীর স্বপ্নদর্শনে?না কি এই প্রাকৃতিক পরিবেশ, স্থানমাহাত্বের জন্য? ' কথিত আছে এইসব ভাবতে ভাবতে গঙ্গাস্নান করে পিছন ফিরতেই মায়ের পূজার উপকরণ দেখতে পান। পরম ভক্তিতে মায়ের পুজো দিয়ে প্রসাদ খেয়ে সুস্থ হলেন।
খোঁজ নিয়ে জানলেন,জায়গাটির নাম 'খুর্দেশা -মোহাম্মদপুর ' , ভাগীরথীর পাড়ে প্রাচীন বট ও বেলগাছের নিচে প্রতিষ্ঠিত হলো সিদ্ধেশ্বরী মায়ের মন্দির।
, ' এই গ্রামের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সিদ্ধেশ্বরী কালী মাতার নাম অনুসারে গ্রামের নাম হয় কালীগড়ঃ বা কেলেগড়ঃ। পরে ব্রিটিশ রাজত্বে সরকারী কাগজপত্রে নাম লেখা হলো কালিয়াগড়।রোহিনীকান্ত মুখোপাধ্যায় প্রণীত কুলসার সংগ্রহ গ্রন্থে এই মন্দিরের প্রাচীনত্বের কথা জানা যায়। সেন বংশের আদিশূরের রাজত্বকালে ৯৫৪ শকাব্দ অর্থাৎ ১০৩২ খ্রিস্টাব্দে সিদ্ধেশ্বরী কালী মাতার পূজার সূচনা হয়।
সেই ব্রাহ্মণ মানুষটির পদবি ছিল মুখোপাধ্যায় , কিন্তু সিদ্ধেশ্বরী মায়ের পূজার অধিকার লাভ করেছেন বলে তিনি ও তাঁর বংশধরেরা অধিকারী পদবি ধারণ করেছিলেন।অধিকারী বংশের শেষ পুরুষ চন্দ্রনাথ অধিকারী ১২২৭ সনে স্বর্গলাভ করেন এবং তাঁর ভাগিনা কালীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায় এরপর থেকে মায়ের পূজার ভার নেন।
ওপর একটি মতে ,একসময় এই অঞ্চলেই বাস ছিল কুখ্যাত কেলে ডাকাতের , তার নাম অনুসারেই এই জায়গাটির নাম কেলেগড় বা কালিয়াগড়।
সেই হিসাবে দেখতে গেলে ,কালিয়াগড়ের সিদ্ধেশ্বরী পূজা প্রায় 1000 বছরের ইতিহাস বহন করছে ......
300 বছর আগেও মন্দিরের পাশ দিয়ে ভাগীরথীর ধারা প্রবাহিত হতো, কালের নিয়মে আজ ভাগীরথী প্রায় 4 কিমি সরে গেছে,কিন্তু মন্দিরের গায়ের প্রাচীন অশথ্বগাছ ও বাঁধানো সিঁড়ি ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজ রয়েছে .......
আজ ও সারা বছর ও কালীপুজোর দিন মহা ধুমধামের সাথে মাতৃ আরাধনা হয়। আগে প্রচুর বলি হতো ,কিন্তু মানুষের সচেতনতায় বলি কমতে কমতে এখন প্রায় শেষের পথে। কিন্তু মাতৃ আরাধনায় জিরাট ও আশেপাশের গ্রামের মানুষের উৎসাহ ও উদ্দীপনা একটুও কমেনি, বরং বেড়েছে।
No comments:
Post a Comment