Friday, 8 December 2017

বর্গিডাঙ্গা / ইটাচুনা রাজবাড়ী

"খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো

বর্গি এল দেশে ,

বুলবুলিতে ধান খেয়েছে

খাজনা দেব কিসে? "

আজ থেকে প্রায় তিনশো বছর আগের কথা।১৭৪০ সাল।সরফরাজ খাঁকে হত্যা করে আলিবর্দি খাঁ বাংলার নবাব হয়েছেন।সরফরাজের শ্যালক রুস্তম জঙ্গ ছিলেন ওড়িশার নায়েব নাজিম।তিনি ভগ্নিপতি হত্যার প্রতিশোধ নিতে আলিবর্দিকে আক্রমণ করলেন। কিন্তু বালেশ্বরের কাছে এক যুদ্ধে রুস্তম আলিবর্দির কাছে পরাজিত হন।ওড়িশার মসনদে বসলেন আলিবর্দির ভাগ্নে। বিজয়ী আলিবর্দি খুশিমনে রওনা দিলেন মুর্শিদাবাদে নিজের রাজধানীতে।এদিকে রুস্তম জঙ্গও নিজের রাজত্ব ফিরে পেতে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করলেন। এবার আর একা নন , নাগপুরের মারাঠা শাসক রঘুজী ভোঁসলের সাহায্য চাইলেন রুস্তম। মারাঠা শক্তির সহায়তায় রুস্তম পুনরায় ওড়িশার নায়েব নাজিম হলেন বটে , কিন্তু বাংলা ,বিহার ওড়িশার আকাশে বয়ে নিয়ে এলেন দুর্যোগের কালো মেঘ , বর্গিহানা....................... মারাঠারা বুঝে নিল সুজলা, সুফলা, শস্যশ্যামলা বাংলার বুকে রয়েছে অশেষ সম্পদ।তা লুটে নেওয়াও খুব সহজ। এর পর থেকেই নিয়মিত মারাঠা বর্গির হানা শুরু হল বাংলায়।ভাস্কর পন্ডিতের নেতৃত্বে হুগলি জেলায় চুঁচুঁড়া, সপ্তগ্রাম, আরামবাগ, পান্ডুয়া ইত্যাদি অঞ্চল তছনছ করে দিয়েছিল বর্গিরা। তবে কয়েকটি অঞ্চলে বর্গিরা হারও মেনেছিল। যেমন বাঁশবেড়িয়ায়।আর একটি বাধা বর্গিরা টপকাতে পারেনি, সেটি হল গঙ্গা। পাঞ্চেত দিয়ে ঢুকে তারা যাবতীয় অত্যাচার চালাত গঙ্গার এপারেই। ১৭৫১ সাল পর্যন্ত বর্গিদের এই অত্যাচার চলে। শেষ পর্যন্ত বাংলার নবাব ও মারাঠাদের মধ্যে চুক্তি সম্পাদন হওয়ার পর শান্তি ফিরে আসে বাংলায়।
অষ্টাদশ শতাব্দীর লুটতরাজপ্রিয় অশ্বারোহী মারাঠা সৈন্যদলের নাম ‘বর্গি’। বাংলার নানান স্থানে প্রতি বছর প্রায় নিয়মকরেই একটা নির্দিষ্ট সময় (১৭৪১ – ১৭৫১) পর্যন্ত মারাঠাদের কিছু সংঘবদ্ধ লুটেরা এদেশে এসে লুটপাট করতো, সৃষ্টি করতো বিশৃঙ্খলার। লুট করে নিতো খেতের ফসল। ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দিতো, হত্যা করতো নিরীহ মানুষ। এইসব লুটেরাদেরকেই বাংলার মানুষজন বর্গী বলে ডাকতো। বর্গিহানা এই সময় একপ্রকার বাৎসরিক ঘটনায় পরিণত হয়েছিল।
মারাঠি ধনগর জাতীয় লোকেরা অভিযানে যাওয়ার সময় কেবলমাত্র একটি সাত হাত লম্বা কম্বল ও বর্শা নিয়ে বের হত। এই বর্শাকে মারাঠি ভাষায় বলা হত ‘বরচি’। এই নাম থেকেই ধনগররা বারগির বা বর্গা ধনগর বা বর্গি নামে পরিচিত হয়। বর্গি শব্দটি মারাঠি বারগির শব্দের অপভ্রংশ। বারগির বলতে মারাঠা সাম্রাজ্যের সেই সব অশ্বারোহীদের বোঝাত। এরা ছিল ধনগর জাতীয় এবং মারাঠা নেতা ছত্রপতি শিভাজী মারাঠী প্রশাসন কর্তৃক এদের ঘোড়া ও অস্ত্র সরবরাহ করা হত। মারাঠারা প্রধানত ভারতের মহারাষ্ট্রের অধিবাসী হলেও তারা ভারতবর্ষের গোয়া গুজরাট কর্নাটক অন্ধ্রপ্রদেশ তামিলনাড়ু– ও মধ্য প্রদেশেও বাস করে। সনাতন ধর্মের অনুসারী মারাঠারা মুগল আমলে ছিল ক্ষত্রিয় যোদ্ধা।
মারাঠাদের অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন ছত্রপতি শিবাজী (১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৬২৭-এপ্রিল ৩, ১৬৮০); তিনিই ১৬৭৪ সালে মহারাষ্ট্রের মারাঠী সাম্রাজ্যটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । মারাঠী সাম্রাজ্য রাজধানী ছিল মহারাষ্ট্রের রাইগাড। ১৮১৮ অবধি মারাঠী সাম্রাজ্যটি টিকে ছিল। মারাঠী সাম্রাজ্য পতনের কারণ ভারতবর্ষে নতুন শক্তির আগ্রাসন।
মুগল সম্রাট আওরঙ্গজেব (নভেম্বর ৪, ১৬১৮-মার্চ ৩, ১৭০৭) সম্রাটের দক্ষিণ ভারতের সামরিক অভিযানের সময় মারাঠা সাম্রাজ্যটি ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে, যার ফলে মারাঠারা মুগল শাসনের প্রতি বিক্ষুব্দ হয়ে উঠে। যেহেতু মুগল আমলে মারাঠারা ছিল হিন্দু ক্ষত্রিয় যোদ্ধা সুতরাং সম্রাট আওরঙ্গজেব মনসব পদ দিয়ে মারাঠা সৈন্যদের মুগল সেনাবাহিনীতে অর্ন্তভূক্ত করে মারাঠাদের রোষ প্রশমিত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতে তেমন কোনো লাভ হয়নি। কিছু কিছু মারাঠা সেনাপতি সম্রাট আওরঙ্গজেব-এর অনুগত থাকলেও বেশির ভাগ মারাঠা সৈন্যই রোষবশত ভারতবর্ষে মুগল শাসিত প্রদেশগুলিতে লুঠপাঠ আরম্ভ করে। রোষের শিকার মুগল শাসিত প্রদেশগুলিতে সুবা বাংলা ছিল অন্যতম।
বাংলা মুগলশাসিত প্রদেশ বলেই ১৭৪২ থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত বার বার বাংলায় বর্গীদের আক্রমন সংঘটিত হতে থাকে। নওয়াব আলীবর্দী খান ১৭৪০ সালে বাংলার নওয়াব নিযুক্ত হন। ১৭৪২ সালের ১৫ এপ্রিল বর্গীরা বর্ধমান আক্রমন করে। জরুরি সংবাদ পেয়ে নওয়াব আলীবর্দী খান সসৈন্য বর্ধমানের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। বর্গীদের নেতা ছিল ভাস্কর পন্ডিত, তার নির্দেশে বর্গীরা নওয়াব-এর রসদ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ২৬ এপ্রিল বর্গী বেষ্টনী ছিন্ন করে কোনওমতে প্রাণে বাঁচেন নওয়াব ।
৬ মে, ১৭৪২। মুর্শিদাবাদের দ্বারপ্রান্তে সশস্ত্র বর্গীরা এসে উপনীত হল। নওয়াব আলীবর্দী খান সে সময় মুর্শিদাবাদে ছিলেন না। নির্মম বর্গীরা মুর্শিদাবাদ নগরের বড় একটি বাজার পুড়িয়ে দেয়। এবং এভাবে বর্গীদের নির্বিকার ধ্বংসযজ্ঞ বাংলার মানসে চিরতরে প্রোথিত হতে থাকে: যে রুদ্ধশ্বাস অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছিল মনোরম বিষন্ন একটি ছড়ার আকারে ...
খোকা ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো
বর্গী এল দেশে,
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দেব কীসে?
মুর্শিদাবাদ নগরে জগৎ শেঠ নামে এক ধনী সওদাগর বাস করতেন । বর্গীরা তার কাছ থেকে ৩ লক্ষ টাকা আদায় করে নেয়। পরের দিনই, অর্থাৎ ৭ মে নওয়াব আলীবর্দী খান মুর্শিদাবাদ উপস্থিত হন। ততক্ষণে মুর্শিদাবাদের অনেকটা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়খার করে বর্গীরা আরও দক্ষিণে পালিয়ে গেছে ।
১৭৪২ সালের জুলাই মাসে, অর্থাৎ মুর্শিদাবাদ আক্রমনের ২ মাস পর হুগলি জেলায় বর্গীরা একটি সৈন্য শিবির স্থাপন করে এবং খাজনা আদায় করতে লাগল। বর্গিদের একটা অংশ থেকে গেল এই হুগলী জেলায়। হুগলী জেলার সেই গ্রামের নামকরণ হলো "বর্গীডাঙ্গা '......
রাধামাধব কুন্দন নামে এক বর্গীসেনা কেন বরগীডাঙ্গায় বসবাস শুরু করলেন তা ঠিক জানা যায়নি। এই রাধামাধব ই হলেন ইটাচুনার কুন্ডু পরিবারের প্রতিস্ঠাতা। কুন্দন পদবীর বাংলার মানুষের মুখে ধীরে ধীরে কুণ্ডুতে রূপান্তরিত হয়। এই কুন্ডু কিন্তু আমাদের বাংলার কুন্ডু নয়। রাধামাধব বর্গীডাঙ্গার উর্বর জমিতে চাষবাস শুরু করে থিতু হলেন। আর কিছুদিন পর রাধামাধবের এক বংশধর স্বপ্নে দেখেন বর্গীডাঙ্গার পাশেই ইটাচুনা গ্রামে এক জঙ্গলের মধ্যে অবহেলিত পরে আছেন তাঁদের ইষ্টদেবতা শ্রীধর জিউ। বিগ্রহ উদ্ধার করে প্রতিষ্ঠিত হলো শ্রীধরজিউ এর মন্দির ,এবং মন্দিরকে কেন্দ্র করে তৈরি হলো কুন্দন রাজবাড়ী। রাধামাধবের বংশধর সাফল্যরাম ১৭৬৬ সালে রাজবাড়ী নির্মাণ করলেন, এবং রাজবাড়িকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পেশার লোকজনদের নিয়ে গড়ে উঠলো ইটাচুনা গ্রাম। নির্মম লুঠেরা বর্গী-দস্যু কুন্দনরা হয়ে গেল আমাদের পাশের বাড়ির কুন্ডু।
সপ্তদশ ও অস্টাদশ শতকে বাংলার রেশমি কাপড়ের আড়ংগুলি (আড়ং শব্দটা ফারসি। আড়ং বলতে বড় আকারের বাজারকে বোঝায়) ছিল জমজমাট। বর্গী আক্রমনে আড়ংগুলি লোকশূন্য হয়ে পড়ে, আড়ংগুলি খাঁ খাঁ করতে থাকে। বাংলার অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়তে থাকে। বাংলাজুড়ে খাদ্যশস্যের অভাব দেখা দেয়, ব্যবসা-বানিজ্য বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। যা হোক। বর্গীরা চৌথ আদায় করতে থাকে এবং পুবের যশোর জেলা অবধি বর্গীদের খাজনা আদায় ক্রমেই সম্প্রসারিত হতে থাকে। বর্গীদের নির্মম অত্যাচারে বহু লোক ভিটেমাটির মায়া ত্যাগ করে গঙ্গার পূর্বাঞ্চলে ( বর্তমান বাংলাদেশে) চলে আসে। পূর্বাঞ্চলের বাঙালিরাও বর্গী লুন্ঠনের শিকার হয়।
বাংলাপিডিয়ায় মোহাম্মদ শাহ লিখেছেন, ‘ঘন ঘন মারাঠা হামলা বাংলাকে মহাবিপর্যয়ে নিপতিত করে। বাংলার জনগনের জন্য এটা এতটাই ধ্বংস আর দুঃখ বয়ে আনে যে, মারাঠা বর্গীদের হামলার ভীতিকর গল্প বাংলার শিশুদের ঘুমপাড়ানি গানে বিশেষ স্থান অধিকার করে। এর সাথে অজন্মা ও খরা মিলে বাংলার অবস্থা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে। মারাঠা হানাদাররা লুন্ঠন, অগ্নি সংযোগ ও হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে বাংলার জনগনের মনে এমনি ত্রাসের সঞ্চার করেছিল যে, বহুলোক তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে গঙ্গার পূর্বদিকের জেলাগুলিতে পালিয়ে যায়। এতে উক্ত এলাকার জনসংখ্যার চাপ বৃদ্ধি পেয়ে মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করে। মূল এই অর্থনৈতিক সংকটই পরবর্তী সময়ে বাংলার নওয়াবকে বিপর্যস্ত ও পর্যুদস্ত করে।’
বাংলার ইতিহাসে মীর জাফরের আগেও মীর হাবিব নামে বাংলায় আরও একজন বিশ্বাসঘাতক ছিল! পারস্য সেই অভিজাতটি এক সময় নওয়াব আলীবর্দী খানের ঘনিষ্ট ছিল; অথচ, এই লোকটিই লোকাল এজেন্ট হিসেবে বর্গীদের সাহায্য করত! আসলে মীর হাবিব ছিল রাজাকার; তার বাংলা সম্বন্ধে খুঁটিনাটি জ্ঞান ছিল। বর্গীরা সে জ্ঞান প্রয়োগ করে সহজেই বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত!
১৭৪২ সালের মাঝামাঝি বাংলা থেকে বর্গীদের নিমূর্ল করার কঠিন সিদ্ধান্ত নেন নওয়াব আলীবর্দী। নওয়াবের এ সিদ্ধান্ত বাঙালিদের ভালোবেসে নয়, দিল্লির প্রাপ্য খাজনায় বর্গীরা ভাগ বসাচ্ছিল বলেই। ১৭৪৩ সালে বর্গীরা মেদিনীপুর আক্রমন করে। নওয়াব আলীবর্দীর নেতৃত্বে মুগল সৈন্যরা মেদিনীপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ৯ ফেব্রুয়ারি দুপক্ষের তুমুল সংর্ঘষ হয়। নওয়াব আলীবর্দীর উন্নততর রণকৌশলের ফলে মেদিনীপুর থেকে বর্গীরা উৎখাত হয়ে যায়। ১৭৪৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বর্গী নেতা ভাস্কর পন্ডিত আবার বাংলা আক্রমন করে বসে। নওয়াব আলীবর্দী খান বাধ্য হয়ে এবার ষড়যন্ত্রের পথ ধরেন। বর্গী নেতা ভাস্কর পন্ডিতকে বৈঠকের আহবান জানান। বৈঠকে ২১ জন বর্গীসহ ভাস্কর পন্ডিত এলে তাঁবুর আড়ালে লুকিয়ে থাকা মুগল সৈন্যদের আক্রমনে বর্গীরা নিহত হয়। ১৭৫০ সালের বর্গীরা আবার বাংলায় হানা দেয়। ১৭৫১ সালে বর্গী আক্রমনের তীব্রতা এতই বেড়ে যায় যে, নবাব আলীবর্দী খানকে মারাঠা-বর্গীদের সঙ্গে সন্ধিচুক্তি করেন। এই সন্ধিচুক্তি অনুযায়ী তিনি উড়িষ্যার অধিকার ছেড়ে দেন। চুক্তির শর্তানুসারে মীর হাবিব নওয়াবের কর্মকর্তা হিসেবে পরিগণিত হবেন এবং উড়িষ্যায় নওয়াবের নায়েব নাজিম বা ডেপুটি গভর্নরের দায়িত্ব পালন করবেন; আলীবর্দী মীর হাবিবের জন্য উড়িষ্যায় ১২ লক্ষ টাকা চৌথ পাঠাবেন এবং প্রদেশের রাজস্বের উদ্বৃত্ত টাকা রঘুজীকে পাঠাবেন। এ চুক্তি অনুসারে ভবিষ্যতে আর কখনও যেন আলীবর্দীর এলাকায় হানাদার মারাঠাদের পদার্পণ না ঘটে মারাঠা সরকার সেই অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। কিন্তু ১৭৫২ সালের ২৪ আগস্ট মারাঠা সৈন্যদের হাতে মীর হাবিব নিহত হলে আলীবর্দী উড়িষ্যায় তাঁর নিয়ন্ত্রণ হারান এবং প্রদেশটিতে পুনরায় মারাঠাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
আর তার মাত্র ৬ বছর পর ইংরেজদের করতলগত হয়ে যায় বাংলা । ওদিকে মারাঠা-বর্গীরা মুগলদের পরির্বতে নতুন এই শক্তির মুখোমুখি হতে হয়- যে শক্তিটি মুগলদের চেয়ে সহস্রগুণ চতুর খল ও শক্তিশালী।
কুন্দন বা কুন্ডু পরিবারের বর্তমান প্রজন্মের উদ্যোগে বনেদিয়ানা ও বৈভবে ভরপুর রাজবাড়ীর অন্দরমহল বর্তমানে গেস্টহাউস। এই বনেদিয়ানা , বৈভব ও ই ‘ইটাচুনা রাজবাড়ী’। বর্তমান হুগলীর মগরার কাছে অবস্থিত এই রাজবাড়ী এখনও রাজাদের আবাসস্থল এবং পান্থের পান্থশালা। ছেলেবেলা থেকে রাজবাড়ীর কথা শুনে আসছি, ইচ্ছে হল রাজ অতিথি হবার ।২০১৫ সালে সুযোগ ও এসে গেল একদিন, আমার স্ত্রী স্বাতী কয়েক দিনের জন্য বাপের বাড়ি গেল।প্রোগ্রাম বানিয়ে বেরিয়ে পরলাম,একা ।
বর্ষার সকাল, আকাশের রঙ যত্ন করে মোছা শ্লেটের মতো চকচকে কালো। এখন বৃষ্টি হচ্ছেনা ঠিকই, কিন্তু বাতাসে জলকণার বাড়াবাড়ি চারপাশটাকে ধোঁয়াটে, ঘোলা ঘোলা করে রেখেছে। সারারাত বৃষ্টিতে ভিজে গাছেরা এখন গা ঝাড়া দিয়ে জল ঝড়িয়ে নিচ্ছে। গাছ গুলোর তলায় দাঁড়ালে মনে হতেই পারে যে বৃষ্টি বোধহয় এখনও থামেনি। নেমেছি খান্নান স্টেশানে। স্টেশান থেকে বেরিয়েই বাজার। বাজারে শহুরে জিনিসের অভাব না থাকলেও শহুরে ব্যাস্ততাটা এখানে অনেকটাই ফিঁকে। ৯ টা বেজে গেছে। কিন্তু বাজারটা এখনও তেমন জমে ওঠেনি। ফাঁকা ফাঁকা ঢিলে ঢালা ভাব। বৃষ্টির জন্যই হয়তো এরকম অবস্থা। বাজারের মধ্যেই টোটো স্ট্যান্ড। এই বিজলী রিকশা এখন বিভিন্ন নামে শহরতলী আর মফঃস্বল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এখানেও তার জমকালো উপস্থিতি। তবে এখানকার টোটো চালকদের যাত্রী ধরার হুড়োহুড়ি চোখে পড়ল না। একটা ঝকঝকে টোটো চোখ টানল। তাতে বাজছে চটুল হিন্দি গান – বেশ উচ্চ স্বরে। আর তার চালক সিটের ওপর পা গুটিয়ে বসে সুখটানে মত্ত। “যাবে?” – আমার প্রশ্নে অবাক হয়ে , আমার দিকে একটা অবহেলার দৃষ্টি বুলিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছাড়ল। বোঝা গেল একা আমার জন্য এই সুখের আমেজ সে কোনভাবেই নষ্ট করতে চায়না এবং আমার এই অকিঞ্চিতকর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনও সে মনে করে না। এর মধ্যে আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মাথায় ছাতা। প্যাচপ্যাচে কাদা রাস্তা। হাঁটু অবধি গোটানো প্যান্ট। পিঠে ব্যাগ। তাগিদটা তাই আমার-ই বেশী। আশপাশের টোটো-ওয়ালাদের অবস্থাও প্রায় এক। সবারই গয়ংগচ্ছ ভাব। ঠুনকো অপমানের বোঝা বাড়িয়ে আর কষ্ট পাই কেনো। টোটো চালকের অবজ্ঞা উপেক্ষা করে গলাতে মিষ্টি রস ঢেলে বললাম – “ দাদা ইটাচুনা রাজবাড়ি যাবো। কতো ভাড়া?” – এই কথাতে ঘটে গেল একটা ম্যাজিক। আধ খাওয়া বিড়িটা দূরে ছুড়ে দিয়ে, ঝট্ করে পা টা নামিয়ে, এক মুখ হেঁসে বিনয়ে ঘাড়-টার কাত করে বললো – “ বসুন বসুন। ১০ টাকা দেবেন’খন ।” বোঝা গেল, রাজাদের রাজত্ব না থাকলেও রাজবাড়ির সম্মানটা এখনও এখানে অটুট।
টোটো চলেছে বাজার ছাড়িয়ে। বেশ চওড়া পিচের রাস্তা। বর্ষার অত্যাচারে দু-এক জায়গায় ক্ষত হলেও যথেষ্ট স্বাস্থ্যবতী। রাস্তার দুধারে বড় বড় মূল্যবান সব গাছ রাস্তার ওপর ঘন সবুজ শামিয়ানা টানিয়ে রেখেছে। আর বৃষ্টির জলে ধুয়ে ধুয়ে এই সবুজ শামিয়ানার কোথাও এক ছিঁটে ময়লা নেই। কলকাতার ধোঁয়াটে বর্ষা দেখা চোখ এরকম অমলিন, কোমল, সিক্ত শ্যামলতা দেখে বেশ আরাম পাচ্ছে।
-“স্যার; রাজবাড়িতে কি ঘুরতে?” টোটো চালক ঘাড় ঘুরিয়েছে।
-“ হ্যাঁ ”।
-“ কদিন থাকবেন? ”
-“ কালই চলে যাবো। আজকের রাতটা শুধু। ”
-“ একা একাই এসেছেন? ”
-“ হ্যাঁ – একাই। এই ভরা শ্রাবণে রাজবাড়ি দেখার সঙ্গী আর পেলাম কই!”
-“ হা: হা:। তা ঠিক স্যার। শীত কালে প্রচুর লোক আসে এখানে। এই সময় প্রায় আসেই না বলতে গেলে।”
-“ হুম ”। বিদেশী বিপণনের হাত ধরে এখন যেখানে সেখানে, যখন তখন স্যার ডাকের ছড়াছড়ি।
-“ জানেন স্যার ”; আবার শুরু হল। “এই রাজারা খুব ভালো। এখানকার জন্য অনেক কিছু করেছেন। বাঁদিকে দেখুন স্যার – স্কুল, মেয়েদের। পাশেরটা ছেলেদের। একদম ক্লাস ১২ অবধি। এটা হোস্টেল।” দেখলাম বেশ বড়সড় হস্টেল।ছাত্র সংখ্যা যে খুব খারাপ নয় সেটা বোঝাই যায়। “ এটা কলেজ।” – আমার পথপ্রদর্শকের প্রদর্শন এখনো শেষ হয়নি।“ রাজার নামেই এই কলেজ। ডান দিকে দেখুন হসপিটাল। এই রাজারাই আমাদের এলাকাটাকে আশেপাশের থেকে অনেক উন্নত করে দিয়েছে। কত সিনেমার শুটিং হয় এখানে। রাজবাড়ীতে তো হয়ই।” এরপর শুরু হয়ে গেল সিনেমার লম্বা লিস্ট। অত নাম শোনার ইচ্ছে আর ধৈর্য কোনটাই আমার নেই আপাতত। হ্যাঁ হুঁ করে চললাম।
এতক্ষণে রাজবাড়ীর নাম শুনেই টোটো চালকের ভোল বদলের রহস্যটা আমার সামনে পুরো পরিষ্কার হয়ে গেল। এখানকার লোকেরা তাদের রাজাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। আর রাজারাও আদতে লুঠেরা হলেও কৃতঘ্ন নয়। তারা প্রজাদের ওপর যথেচ্ছ শোষণের প্রতিদান দিতে ভোলেনি। প্রাচীন বর্বরতার কালিমা মুছে রাজারা এখানে সত্যিই প্রজাপরায়ণ।
“ এই যে স্যার এসে গেছি ” – চমক ভাঙল। “ দরকার হলে ডাকবেন স্যার। এই যে কার্ড। আর একটু সাবধানে থাকবেন স্যার। বর্ষার দিনতো।” টাকা নিয়ে, নিজের নাম ছাপা কার্ড আমার হাতে ধরিয়ে টোটোওয়ালা বিদায় নিল।
বৃষ্টিটা একটু ধরেছে। সূর্যও মেঘের ফাঁক দিয়ে আলগোছে উঁকি দিয়ে নিজের অস্তিত্ব বোঝাচ্ছে। একটা জোলো হাওয়া হঠাৎ হঠাৎ করে এসে ভেজা গায়ে শিরশিরাণি তুলছে। আর আমার সামনে এখন এক বাস্তব ইতিহাস। দাঁড়িয়ে আছি ইটাচুনা রাজবাড়ীর সামনে। প্রথমেই একটা ছোট বাগান – সাজানোর চেষ্টা হয়েছিল ঠিকই কিন্তু বর্ষার জলের গুণে আগাছারাই এখন দলে ভারী। বাগানের তিন দিক ঘেরা সুবিশাল অট্টালিকা – সত্যি করেই রাজবাড়ী। বেদানার মতো লাল টকটকে। দোতালা। রাস্তার ঠিক মুখোমুখি কিছুটা অংশ সাদা – তবে শ্বেতপাথরের নয় – চুনকাম করা। এটাই রাজবাড়ীর মুল ফটক। এই ফটকের দুইপাশে দোতালা পর্জন্ত জোড়া থাম উঠে গেছে। তার মাথায় ত্রিভুজাকৃতি তোরণ। গতধরা প্রাচীন ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীর উদাহরণ।
রাস্তা থেকে রাজবাড়ীর সিংহদ্বার অবধি সোজাসুজি কোনো রাস্তা নেই। বাগানকে বাঁয়ে বা ডানে রেখে ঘুরে গিয়ে পৌঁছতে হবে প্রবেশদ্বারে। এই অংশটা রাজবাড়ীর বাহির মহল। এখানেই বাগানের বাঁদিকে রাজবাড়ীর অফিস। বাগানকে ডানে রেখে চলে এলাম সেখানে। খাতায় কলমে রাজবাড়ীর অতিথি হিসাবে নিজেকে নথিভুক্ত করে নিলাম। অফিস ঘরে রাজবাড়ীর একটা ফ্রেম বাঁধানো ছবি ছাড়া আর কিছুই রাজকীয় নয়। মনটা একটু দমে গেল। অফিস ঘর এতো সাদামাটা; ভেতরটা আর কী এমন আহামরী হবে! কিন্তু আমার এই ভাবনাকে থমকে দিয়ে অফিস ঘরে প্রবেশ করেছে এক ঐতিহাসিক চরিত্র। গায়ে ফতুয়া, মালকোচা দেওয়া ধুতি; মাথায় আবার পাগড়ী; আর পায়ে খড়ম। অষ্টাদশ শতকের রাজবাড়ির কর্মচারীরা বোধ হয় এরকমই হত। এই মূর্তিমান ইতিহাস বেশ ঝুঁকে আমায় প্রণাম জানালো এবং আমার ব্যাগটা তুলে নিয়ে এগিয়ে চললো রাজবাড়ীর মূল ফটকের দিকে। আমিও তাকে অনুসরণ করলাম।
অফিস ঘরের সাদামাটা অবস্থা দেখে আমার মনে যে দুশ্চিন্তার চোরাস্রোত বইতে শুরু করেছিলো তা পুরোপুরি চাপা পড়ে গেল মূল রাজবাড়ীর ভেতর ঢুকে। মূল ফটক পেরিয়েই এসে পড়লাম লাল সিমেন্ট বাঁধানো একটা বিরাট চৌকো চাতালে। এর ঠিক মাঝখানে সাদা আলপনা; বৃষ্টির জলে ধুয়ে ধুয়েও এখনও সবটা মুছে যায়নি। সারি সারি নকশাওয়ালা কালো কালো বাতিস্তম্ভ সারা চাতালে ছড়ানো। এই চত্বরটা এতোটাই বড়ো যে এখানে একটা ছোট হাউসিং কমপ্লেক্স তৈরি হতে পারে। এই চত্বরকে ঘিরে রেখেছে দ্বিতল রাজবাড়ী। দোতালায় রেলিং দেওয়া বারান্দা আর টানা ঘর। একতলার বারান্দা গুলো রেলিং ছাড়া। একতলাতেও দোতলার মতো ঘরের সারি। সব ঘরই বন্ধ। মূল ফটকের ঠিক অপরপ্রান্তে চাতালের শেষে অবস্থান করছে এক বিরাট মন্দির। নিঃসন্দেহে রাজাদের গৃহদেবতা। আমার পথপ্রদর্শককে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল এই মন্দিরে রাধা-কৃষ্ণের অধিষ্ঠান। পথপ্রদর্শকের নামটাও এর মধ্যে জেনে ফেলেছি – কমল।রাজকর্মচারীদের মতই গাম্ভীর্য আর প্রশ্নের উত্তরে বেশী শব্দের ব্যাবহার এর নীতিবিরদ্ধ। কমল এখন আমাকে আর মন্দিরের দিকে না নিয়ে গিয়ে ডানদিকের একটা ছোট দরজা দিয়ে নিয়ে এলো একদম অন্দরমহলে। এই অন্দরমহলের মাঝখানেও সিমেন্ট বাঁধানো উঠোন। তবে এটা অনেক ছোট। বাইরের চাতালের এক চতুর্থাংশ। এই উঠোনের চারপাশ দিয়ে ঘর। বাড়িটা দোতালা।
এরকম তিনমহলা বাড়ি দেখার অভিজ্ঞতা আমার প্রথম। ভাবতে অবাক লাগে এতো বড়ো বাড়ি নিশ্চয়ই রাজাদের রাজত্বকালে কোলাহল মুখরিত ছিল। কতো হাসি-কান্না, রাগ-অভিমান, হিংসা-ভালোবাসার স্মৃতি জড়িয়ে আছে এর মোটা মোটা লাল দেওয়ালের আনাচে কানাচে। আজ সব ফাঁকা, শুনশান, নিঃশব্দ; লোকজনেরও দেখা নেই। এতো বড়ো রাজবাড়ীতে এখনও পর্যন্ত মাত্র দুজন মানুষকে দেখলাম। এক ঐ অফিসের অফিসবাবু আর দুই আমার পথপ্রদর্শক কমল। আমাকে চাতালে এনে দাঁড় করিয়ে রেখে সেও কোন গোপন কুঠুরীতে আত্মগোপন করেছে।
এই চতুর্ভুজ একতলাটার দুই বাহুতে থাকার ঘর। আর অবশিষ্ট দুই বাহুর একটা মনে হয় রান্নাঘর আর অন্যটায় খাবার ঘর। রান্নাঘর আর খাবার ঘরে একাধিক দরজা। তার একটা দিয়ে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল কমলকে। হাতে একটা পাত্র। অত্যন্ত পুরানো। এখনকার দিনে ওরকম পাত্র দেখাই যায়না। তাই নাম জানারও প্রশ্নই ওঠেনা।
“ স্যার, পা ধোয়ার জল এনিচি; পা টা ধুয়ে নিন।”
কানে কট্ করে লাগলো কথাটা। বেশ একটা পুরোনো সময়ে চলে গেছিলাম। ‘স্যার’ কথাটা যেন টাইম মেশিনের হ্যান্ডেলটাকে এক ঝটকায় ঘুরিয়ে একবিংশ শতকে ফিরিয়ে আনল। বড্ড বেমানান।
পা ধুয়ে প্রবেশ করলাম অন্দরমহলের অন্দরে। পরিপাটি করে সাজানো বসার ঘর। উপর থেকে ঝুলছে চাইনিজ ঝাড়বাতি। বসার জন্য রাজকীয় সোফা – নতুন করে তাতে পালিশ পরেছে। সোফার নরম গদিতে শরীর ছেড়ে দিতে না দিতেই পোশাকে প্রাচীন বয়সে নবীন এক চরিত্রের প্রবেশ। আমার দেখা রাজবাড়ীর লোক সংখ্যা দুই থেকে তিন হলো এবার। এর হাতে পিতলের রেকাব – তার উপর বসানো পিতলের পানপাত্র। অতিথিকে আপ্যায়ন জানানোর রাজকীয় প্রথা। রাজবাড়ির সুদৃশ্য পানপাত্র শুনে হয়তো পাঠকের প্রত্যাশাটা একটা অন্য খাতে বইতে শুরু করতে পারে। কিন্তু এই পানপাত্র নুন-লেবু-চিনির অতি পরিচিত সরবতেই পরিপূর্ণ। অন্যরকম পানীয়ের কল্পনা সম্পূর্ণই অমূলক।
আমার জন্য নির্ধারিত হয়েছে ‘ছোট পিসির’ ঘর। কমলের মুখে কথাটা শুনে অবাকই হলাম। ছোট পিসি আমার ওপর দয়াপরবশ হয়ে আজকের রাতটা নিজের ঘর ছেড়ে দিয়েছেন, না কি? না তা নয়। কমল আমাকে আশ্বস্ত করল ওটা নামেই ছোট পিসির ঘর। কিন্তু রাজাদের এই ছোট পিসি কোথায় থাকেন বা আদতে আছেন কিনা সে প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ অবান্তর। এখানকার সব অতিথি আপ্যায়ণের ঘরের নামের সঙ্গেই এবাড়ির বাসিন্দাদের – ‘ বড় বৌদি’, ‘ ছোড়দা’, ‘ঠাকুমা’ নিত্য যোগাযোগ।
কমলের সাথে উঠে এলাম দোতলায়। সিঁড়িটা এসে শেষ হয়েছে চতুর্কোণ দোতলার এক কোণে। এর দুই দিকে দুই বাহু। আমরা ডানদিকের বাহু দিয়ে এগোলাম। লম্বা করিডর। তার ডানপাশে ঘর আর বাঁপাশে বারান্দা। করিডোরে সুসজ্জিত বিলাস বহুল সোফা পাতা। একেকটা একেক রকম। অপূর্ব কারুকাজ। অঙ্গসজ্জায় একে অপরকে প্রাণপণ টেক্কা দেওয়ার চেষ্টা করছে। এতো রকমের বসার আসবাব যে হয় তা আমার ধারণার বাইরে ছিল। বসার থেকে এগুলো দেখেই বেশী আনন্দ পাওয়া যায়। করিডরের বারান্দার দিকের জানালায় রঙ্গিন কাঁচ। সেইসব কাঁচ ভেদ করে আসা রঙিন আলো জায়গাটাকে মায়াবী করে রেখেছে। করিডর এর বারান্দার দিকের দরজা দিয়ে এসে দাঁড়ালাম রেলিং ঘেরা বারান্দায়। রেলিং ধরে ঝুঁকলে নিচের উঠোন দেখা যায়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলাম চতুর্ভুজ দোতলার তিন ভুজের নকশা একই রকম। এই তিন দিক জুড়েই পরপর বারান্দা, করিডর আর ঘর। আর আমার ডানপাশে, দোতলার একদিক জুড়ে খোলা ছাদ। বারান্দা দিয়ে চলে এলাম খোলা ছাদে। বৃষ্টির জলে জায়গাটা পিছল। আর এখানে ভিড় জমিয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির অর্কিড। তাদের কোনটাতে আবার ফুল ফুটেছে। ছাদ পেরিয়ে আবার একই রকম বারান্দা, করিডর, ঘর। দোতালাটা পুরোটাই সংযুক্ত। পুরোটা চক্কর দিয়ে আবার প্রথম দেখা করিডোরেই ফিরে এলাম। এখানে পর পর তিনটে ঘরের মধ্যে দুটি বন্ধ আর মাঝেরটা খোলা। দরজায় ভারী পর্দা ঝুলছে। দরজার পাশের দেওয়ালে কায়দা করে লেখা ‘ছোট পিসির ঘর’। তাহলে এই ঘরটাই আজকে রাতে আমার ঠিকানা।
পা দিলাম ঘরের ভেতরে। সিনেমায় দেখা রাজবাড়ীর সাথে হুবহু মিল। মোটা মোটা দেওয়াল। হলদেটে আলোয় ঘরটা মাখামাখি হয়ে আছে। অদ্ভুত রকমের ঠাণ্ডা মেঝে। মার্বেল পাথরের। সাদা কালো ছক মেলানো। ঘরটা পেল্লায় রকমের বড়। শপিং মলের ফুড কোর্ট এর মধ্যে সহজেই ঢুকে যেতে পারে। প্রায় আড়াই মানুষ সমান উঁচু সিলিং। ওপর থেকে নেমে আসা রড থেকে ঝুলে ঘুরছে ইলেকট্রিক ফ্যান। হাতে টানা পাখার বন্দোবস্ত থাকলেও তা নেহাতই স্মৃতিচিহ্ন। ঘরের ডানদিকটা পুরোটা জুড়ে রয়েছে একটা পালঙ্ক – সত্যি পালঙ্ক বলতে মনের মধ্যে এরকমই ছবি ফুটে ওঠে। চকচকে কালো মেহগনী পালিশ। অপূর্ব তার কারুকাজ। এর অঙ্গ জুড়ে জড়িয়ে থাকা ব্রীড়া, তনু বিভঙ্গ মনকে মুগ্ধ করে। আর এটা এতোটাই বড় যে এতে তিন-চার জন লোক অনায়াসে শুতে পারে। এই পালঙ্কের সাথের দেওয়াল জুড়ে দেওয়াল আলমারি। এই আলমারীর পালিশ এবং কারুকাজে পালঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। ঘরের বাঁদিকে ড্রেসিং টেবিল, লেখার টেবিল, ওয়ারড্রব দেওয়াল ঘেঁসে পাশাপাশি রাখা। এরাও যথেষ্ট সুন্দরী এবং ঘরের মানানসই। ঘরের মাঝখানে পাতা কার্পেট। তাকে ঘিরে গদি আঁটা সুদৃশ্য চেয়ার সাজিয়ে বসার জায়গা করা রয়েছে। প্রত্যেকটা আসবাবই বেশ পুরনো কিন্তু তাদের গা দিয়ে এখনও আলো পিছলে যায়। অর্থাৎ নিঃসন্দেহে এরা সযত্নে লালিত। দেওয়ালে ঝুলছে একটা ওয়েল পেন্টিং। এক মহিলার। রাজাদেরই কেউ হবেন হয়তো। হয়তবা ‘ছোটপিসির’ যৌবনই এখানে ফ্রেম বন্দি। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন একটা থামের গায়ে হেলান দিয়ে। শিল্পের দিক থেকে এই ছবি খুব উঁচূ মানের না হলেও এটা নিঃসন্দেহে ঘরের আভিজাত্য কয়েকগুণ বাড়িয়ে তুলেছে।
ঘরেরই একটা চেয়ারে বসলাম বেশ আরাম করে। এই সময় একটু চা যদি পেতাম, মন্দ হতনা। কিন্তু বলবই বা কাকে। কমলতো ঘর গুছিয়েই বেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। এরকম একটা বিলাসবহুল সেকেলে জমিদার বাড়িতে বসে মনটা বেশ অন্যরকম হয়ে গেছে। এই অনুভুতিটার জন্যইতো এতো কষ্ট করে বৃষ্টি মাথায় করে এখানে আসা। আশা করি দিনটা যাবে না, বেশ ভালোই কাটবে। “আপনার চা” – কমলের ডাকে ঘর ভাঙল। এক্ষুনি ভাবছিলাম চায়ের কথা, আর চা নিয়ে হাজির। মন পড়তে পারে নাকি! যখন যা চাইব বলে ভাবছি সেটা নিয়েই হাজির হয়ে যাচ্ছে। এই লোকটা বেশ অবাক করছে। একে কথা তো প্রায় বলেই না। তার ওপর আদ্যিকালের পোশাকে মোড়া রোগাটে ক্ষয়াটে চেহারা। দেখে মনে হয় যেন রাজবাড়ির প্রথমদিন থেকেই এই লোক একই ভাবে নীরবে কাজ করে চলেছে। এ যেন জন্ম মৃত্যুর ঊর্ধে। রাজবাড়িতে এর উপস্থিতি যেন কেউ টলাতে পারেনি। শুধু রাজবাড়ির এই দুর্দিনে এর মুখে পড়েছে একটা মলিন ছায়া। বর্ষামুখর দিনে পুরনো রাজবাড়িতে এরকম একটা চরিত্রের উপস্থিতি বেশ উপভোগ্য গা ছমছমে ভাবের সঞ্চার করেছে।
চা টা শেষ করে স্নানের তোড়জোড় শুরু করলাম। ১২ টা বেজে গেছে এর মধ্যেই। ঘরের সাথেই বাথরুম। কাঠের মোটা পাল্লার দরজা। ঢুকলাম ভেতরে। এর যা সাইজ তাতে করে এতে ছোট ফ্ল্যাটের একটা বেডরুম অথবা বড়ো ফ্ল্যাটের একটা গেস্টরুম বানানোই যায়। কিন্তু রাজবাড়ি বলে কথা। তার বাথরুমটাও তো রাজকীয় হওয়া চাই। তবে এর অঙ্গসজ্জায় কোন প্রাচীনতা নেই। পুরোটাই আধুনিক ব্যাবস্থা। প্যাচপ্যাচে ঘাম আর বৃষ্টি ভেজা শরীর কৃত্রিম বৃষ্টিধারায় পেতে দিলাম – আহঃ! কী আরাম। কানে ভেসে আসছে সুরেলা মার্জিত কন্ঠের উৎকৃষ্ট ঠুমরী – ‘ননদিয়া কাঁহে মোরে বোল’। বেশ পুরনো দিনের মার্জনা। রেকর্ড বাজছে কোথাও হয়ত। ঘর থেকে শোনা যায়নি কিন্তু বাথরুম থেকে বেশ স্পষ্ট।
ফিটফাট হয়ে বসতে না বসতেই দরজায় টক টক। যথারীতি কমল। “আসুন। ভাত বেড়িচি।” একতলা খাবার ঘরে এলাম। সাবেকি আমলের চেয়ার টেবিল, জল ঢাকা কাঁসার গ্লাসে। খাবারও এল কাঁসার থালা বাটিতে রাজবাড়ির সম্মান বজায় রেখে। বাটি ভাত। তার পাশে কাত করে রাখা দুটো লুচি। থালার আশ পাশ দিয়ে সাজানো হতে লাগলো ষোড়শ উপাচার। পাতে পড়ল ঘি। তারপর শুক্তোয় মুখ তিতো করে সুগন্ধি মুগডালে গলা ভিজিয়ে, আরো সব ব্যঞ্জন সামলে যখন মাংসের বাটির দিকে হাত বাড়ালাম ততক্ষণে পেট ভরেই গেছে প্রায়। অবশ্য বাদ প্রায় কিছুই দিলাম না। দই মিষ্টি পর্‍্যন্ত চেটেপুটে খেয়ে নিলাম। রাজবাড়ির রাজকীয় ভোজ – অতুলনীয়। ঝিরঝিরে বৃষ্টিটাও আবার শুরু হয়েছে। ভেজা ভেজা ঠান্ডা ঠান্ডা আমেজ। ‘ছোটপিসি’র পালঙ্কটা যেন ডাকছে। কমল বলেছে বিকেলে পুরো বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখাবে। এখনও তার অনেক দেরী। অতএব ছোট করে একটা ভাত ঘুম সেরে নেওয়াই যায়।
বিকেলে বৃষ্টিটা আর নেই। সারাদিন মুখ লুকিয়ে থেকে দিনমণি শেষ বেলায় আশ মিটিয়ে পৃথিবীটাকে দেখে নিচ্ছেন। একটা লালচে হলদে আলো চারিপাশে। ভেজা মাটি থেকে ভাপ উঠে চারিপাশ ধোঁয়া ধোঁয়া। কমলের সাথে ঘুরে বেরাচ্ছি বাড়ির আনাচ কানাচ। রাজবাড়ির বাইরের অংশে পূজা মন্ডপ, ক্ষেত, পুকুর সবই আছে। বাড়ির ভেতরের অংশেও প্রচুর ঘর, বারান্দা – বিভিন্ন রকমের, বিভিন্ন ধরনের। স্পষ্টতই সুন্দর এবং প্রাচীনত্বের ছোঁয়ায় ভরপুর। তবে চোখে পরার মতো হলো একটা দাবার বোর্ড – বরং বলা ভালো দাবার টেবিল। টেবিল জোড়া দাবার ছক। সাদা কালো মার্বেল পাথরের ছক কাটা। অসম্ভব রকমের সুন্দর। আর এতোটাই বড় যে এর এক প্রান্তে বসে আরেক প্রান্ত ছুঁতেই পারা যায়না। গুটিগুলোও মার্বেলের। প্রায় এক ফুট করে লম্বা। আর ছক মেলানো মার্বেলের বারান্দার শেষ প্রান্তে পেতে রাখা এই দাবার ছক একে অপরের সৌন্দর্যকে দ্বিগুণ করেছে। স্মার্টফোন স্ক্রিনে বাঁধা দাবার ছক দেখা চোখ এই বিশালত্বের সামনে হতবাক হতে বাধ্য। এই বারান্দার অপর প্রান্তে ছাদে ওঠার সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে ছাদে। ছাদটা নিঃসন্দেহে বিরাট। রাজবাড়ির তিনটে মহল জোড়া ছাদ। পুরোটা ঘুরে আসতে হলে পায়ের বেশ ধকল সইতে হবে। এই ছাদে আগে কখনও না এলেও মনে হয় যেন খুব চেনা। বুক সমান উঁচু পাচিল; ছোট ছোট করে ভাগ করা। বহু সিনেমায় এরকম ছাদই ঘটনার ঘনঘটায় ঘনঘোর হয়ে ওঠে। ছাদের আলসেতে ভর করে দূরে তাকালে দৃষ্টি দিগন্ত ছুঁয়ে আসে। ক্ষেতের ধারে একটা বড় ফুলে ফুলে হলদে হয়ে থাকা রাধাচুঁড়া গাছের মাথায় আগুন জ্বালিয়ে আজকের মত পথ চলা শেষ করল ক্লান্ত, সিক্ত সূর্য। শাঁখ বেজে উঠল – বোধ হয় নিচের রাধা গোবিন্দ মন্দিরে। “চলুন এবার নিচে যাই। আরতি শুরু হবে মন্দিরে” – অনেকক্ষণ বাদে কমল মুখ খুলেছে।
মন্দিরে অলঙ্কার বিভূষিত, ফুলমালা শোভিত, চন্দন চর্চিত, সুসজ্জিত রাধাকৃষ্ণ পরষ্পরের আলিঙ্গনাবদ্ধ। বয়স্ক পুরোহিত ভক্তিতে অবিচল এবং যত্ন পরায়ণ। কাঁসর সহযোগে আরতি বেশ জমে উঠেছে। আমার উপস্থিতি নিশ্চয়ই পুরোহিত মহাশয়ের উৎসাহ কিছুটা বাড়িয়ে তুলেছে। কারণ এখানে আমিই একমাত্র বহিরাগত এবং আতিথি। সকাল থেকে এবাড়িতে এসে আমায় সব থেকে অবাক করেছে এর নির্জনতা। লোক প্রায় নেই। কাউকে দেখাই যায়না। এখনও অবধি আমি ঠাকুর মশাই কে নিয়ে হাতে গুনে চার জনকে দেখেছি। তাও যেন যন্ত্রচালিত পুতুল। হঠাৎ হঠাৎ করে মাটি ফুঁড়ে সামনে হাজির হয়। তারপর নিজের কাজটা করেই আবার অদৃশ্য হয়ে যায়। কোন কথা নেই মুখে। এক কমল আর দুই অফিস বাবু ছাড়া আর কাউর মুখে আমি কোন কথা শুনিনি। কোন গোপন মন্ত্রের আবেশে আবিষ্ট কিছু লোক যেন ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে এসে দীর্ঘ দিন ধরে একই ভাবে, একই লয়ে, একই ছন্দে, একই রকম কাজ করে চলেছে। সুদূর অতীত থেকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতেও কোন রকম বদল না ঘটেই যেন চলতে থাকবে এই জীবন্ত প্রাচীনতা – অপার স্তব্ধতা।
চা ঘরটা বেশ সুন্দর। ছাতিম তলায়। খড়ের ছাউনি। মাটির দাওয়া। সুদৃশ্য চিনামাটির কাপ প্লেটে চা – গ্রীন টী। বিলাসিতার পালিশে কথাও ধুলো জমার সুযোগ নেই। মন্দিরের আরতি শেষ অবধি দেখার মতো ধৈর্য আর আমার ছিলনা। পিপাসার্ত হয়ে পড়েছিলাম। কমল যথারীতি আমার মন পড়ে ফেলে চা-ঘরে নিয়ে এসেছে। আমায় চা বানিয়ে দিয়ে নিজে এখন একটা দেওয়ালের আড়ালে ধোঁয়া বিলাস করে নিচ্ছে। নিজের শরীরটা লুকিয়ে ফেলেছে ঠিকই কিন্তু ধোঁয়া আর কি করে লুকোবে। দেওয়ালের পিছন থেকে ফুর ফুর করে ধোঁয়া উঠছে।
চা শেষ করে পায়ে পায়ে ঘরে এলাম। এত বড় বাড়ি; এত বড় ঘর; নিস্তব্ধতা; নির্জনতা বেশ একটা আবেশ তৈরী করেছে মনের ওপর। বাথরুমে ঘুরে এলাম। এখনও রেকর্ড বাজছে শোনা যাচ্ছে। আর একই গান। একই গান এতো বার কেউ শোনে? সে যতই ভালো গান হোক। কী জানি কি ব্যাপার? বাথরমের দরজাটা একটু খুলে রাখলাম। যদি ঘর থেকে শোনা যায় গানটা। তাহলে এই নিশ্ছিদ্র নির্জনতায়, বর্ষণমুখরতায়, রাজবাড়ির এক রাজকীয় ঘরে বসে দূর থেকে ভেসে আসা ঠুমরীর তান সন্ধ্যেটা মোহময় করে তুলবে। তবে সেই আশা দুরাশা। ঘর থেকে কিছুই শোনা যায়না। কিন্তু বাথরুম থেকে বেশ স্পষ্ট। তবে বাথরুমে দাঁড়িয়ে শোনাটাও ধৃষ্টতা। আর একই গান বারবার বাজছে। বিরক্তিকরও বটে। কি আর করি – বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। বেশ ঝমঝমিয়ে নেমেছে বৃষ্টিটা এখন। আকাশে বজ্রগর্ভ মেঘের সঞ্চার; ক্ষণবিদ্যুৎ চমকে, সশব্দে, সগর্বে নিজের অস্তিত্ব বোঝাচ্ছে। ঘর থেকে এসবের কিছুই টের পাইনি। মাঝে মাঝে দমকা হাওয়ায় বৃষ্টির ছাঁট এসে গায়ে লাগছে। অতি প্রাচীন সুদৃশ্য রাজবাড়িতে এরকম একটা বর্ষণ্মুখর সন্ধ্যা উপভোগ করতেই তো সকলের বাধা পেরিয়ে এতোদূর ছুটে আসা। সত্যি প্রকৃতিও আমার ওপর স্নেহশীলা। আমার কল্পনাগুলো যেন এক একটা বাস্তব ছবি হয়ে আমার সামনে ফুটে উঠছে।
সূর্যের আলোয় তো বাড়িটা ঘুরে দেখেছি। কিন্তু রাতের আলো আঁধারিতে বাড়িটা একবার ঘুরে দেখলে মন্দ হয়না। প্রকৃতি যেভাবে একের পর এক দৃশ্যপট জুড়ে চলেছেন, তার সাথে যদি আমার উদ্যম খানিকটা মেশে তাহলে একটা ক্লাসিক সিনেমার প্রেক্ষাপট তৈরি হতে আর কতক্ষণ।
আবার ঘুরে দেখতে লাগলাম বাড়ির আনাচ কানাচ। বিকেলের মরা আলোয় যেগুলো দেখেছি ম্রিয়মাণ; সেগুলোই হলদে বাল্বের আলো আর আঁধারিতে বেশ রহস্যময়। গুমোট, স্যাঁতস্যাঁতে আর সোদা গন্ধে ভরপুর এই রাজবাড়ির কোষ্ঠ প্রকোষ্ঠ আমার সমস্ত স্বত্বার ওপর যেন ধীরে ধীরে প্রভাব বিস্তার করছে। আর আমিও যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার কাছে আত্মসমর্পণ করছি। বাড়িটার যেন অনেক গোপন কথা বলার ছিল। মনের মতো কাউকে না পেয়ে এতদিন সব কথা নিজের মধ্যে চেপে রেখে গুমরে মরছে। এবার পেয়েছে আমাকে। যেন আমার পথ চেয়েই এতদিন বসে ছিল। আমাকে সমস্ত কথা বলতে না পারলে যেন আজ আর এর শান্তি নেই। সব জমে থাকা কথা যেন আজ উজাড় করে দিতে চায় আমার কাছে। সমস্ত কিছু দেখাতে চায় আমাকে। আমি নিজের ইচ্ছায় আর ঘুরছিনা এখন। আমি এখন বন্দি একটা অদৃশ্য শক্তির কাছে। তার টানেই চরকির মতো ছুটে বেরাচ্ছি আমি, রাজবাড়ির অলিন্দে অলিন্দে। এতো বারান্দা, এতো সাজানো অন্দরমহল। দীর্ঘদিনের আটকে থাকা ক্রুদ্ধ, লোলুপ, মোহময়, ব্যর্থ বিলাসিতা তো কমল আমায় দেখায়নি। রাজবাড়ির রাজকীয়তার যে অসামান্য প্রতিচ্ছবির সামনে এখন এসে আমি দাঁড়িয়েছি; প্রেতের মতো ঘুরে বেরাচ্ছি এই লুন্ঠিত সম্পদের নির্লজ্জ প্রকাশের মাঝখানে......... কই বিকেল বেলায় তো এই সব কিছুই দেখিনি, এরকম পরিবেশ রক্তে একটা উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে। দুর্ধর্ষ মারাঠা জাতির রক্ত যেন আমার ধমণীতে বইতে শুরু করেছে। কোমরে একটা খাপ সমেত তলোয়ার ঝোলানোর জন্য মনটা আকুলি বিকুলি করছে। আমি এখন আর ধোঁয়া ধূলো মাখা শহরের কেউ নই – নই দুর্বল বাঙ্গালী। আমার হাতের পেশী এখন শক্ত, সবল – তাতে অসুরের শক্তি। পৃথিবীর কোন বাঁধন আর এখন আমায় বেঁধে রাখতে পারবে না। আমার সামনে মাথা তুলে দাঁড়ানোর মতো গুরুপাপে পদাঘাতে মস্তক বিচূর্ণ করাটা নেহাতই লঘুদণ্ড। ঘুরতে ঘুরতে একটা আধ ভেজানো দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। ঘরের ভেতরটা আলোকোজ্জ্বল। দরজার ফাঁক গলে আলো তেরছা ভাবে বাইরে এসে পড়ছে। কার এতো সাহস। আমার সামনে দরজা বন্ধ করে রাখার মতো ধৃষ্টতা দেখায়! সজোরে পদাঘাত করলাম দরজায়। প্রাচীন মজবুত দরজার ফ্রেম মট মট করে উঠল। এই আমিকে আমি চিনিনা।
দরজা ঠেলে ঢুকতেই ভিতরের দৃশ্য বেশ চমকে উঠলাম, নিস্তব্ধ, নির্জন রাজবাড়ির এই কুঠুরী প্রাণের স্পন্দন জ্বেলে রেখেছে। তিনটি প্রাণী চিত্রিত রয়েছে বিলাসী প্রাচীন চিত্রে। তারা যেন বসে ছিল আমারই প্রতীক্ষায়। আমার উদ্যম প্রবেশ এদের অপেক্ষার ঘোর কাটিয়েছে। এরা এখন সচকিত। এই তিনটি প্রাণের একটি প্রাণ সুসজ্জিতা, বহুমূল্য বস্ত্রে বিভুষিতা। গাঢ় প্রসাধনে ইনি সময়ের সমস্ত কলঙ্ক মুছে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কলঙ্ক যে চাঁদের রুপকে তুলনাহীন করে, একথা তিনি বুঝতে না পারায়; অতি সাজগোজ তাঁর স্বাভাবিক লাবণ্যের কন্ঠরোধ করেছে। ইনি বয়সে নবীনা না হলেও গোধূলীবেলার অস্তমিত সুর্যের তেজ এর রূপে। তাঁর উপস্থিতি, দেহবল্লরী সঞ্চালন, দৃষ্টি চপলতা স্পষ্ট করে যে এই সম্প্রদায় রাজাদের জীবনে নৃত্যগীতের অভাব ঘটতে দেয়নি। এঁর দুই পাশের অন্য দুটি প্রাণের একটি তবলা আর অন্যটি সারেঙ্গী। এই ত্রয়ীর মুখোমুখি রাখা একটা সুদৃশ্য লাল মখমলের গদি আঁটা চেয়ার রাখা। নিশ্চয়ই আমার জন্যই হবে। আর এতো ঘুরে ঘুরে আমার পায়ে রীতিমতো ব্যাথা করছে। বসতে আর আপত্তি কিসের। চেয়ারে বসে উপরের দিকে চোখ গেল। রঙ্গিন কাঁচের সুদৃশ্য ঝাড়বাতি ছাদ জুড়ে আলপনা এঁকে রেখেছে। কুটিল, জটিল, অপরূপ তার কারুকাজ। সবথেকে বড় ব্যাপার, এই ঝাড়বাতিটা পুরোপুরি মোমের আলোয় উজ্জ্বল। কোন ইলেকট্রিক বাল্বের ব্যবহার নেই এতে। একটা সীমাহীন অবিশ্বাস, চমক, ভালোলাগা মনকে অবশ করে দিয়েছে। আমার পায়ের নীচে লুটিয়ে থাকা গালিচায় বসে থাকা জীবন্ত অলংকার সম্ভার ঝাড়বাতির আলোয় জ্বলতে শুরু করেছে। সেই আলোর ছটা চোখে জ্বালা ধরায়। সেই মোহময়ী এখন আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন গভীর অনুরাগ নিয়ে। একটা কৌতুক মাখা হাসি মুছে গিয়েও ঠোঁটের এক কোণে আলগা ছাপ রেখে গেছে। চোখে চোখ পরার অপেক্ষা। পড়তেই শুরু হোল গান – “ননদিয়ে কাঁহে মোরে বোল”। সেই গান। যেটা সকাল থেকে আমি অন্তত বিশবার শুনেছি আমার ঘরের বাথরুম থেকে। তখন ভেবেছিলাম রেকর্ড বাজছে। রেকর্ড নয় তাহলে। ইনিই সেই ঠুমরী সম্রাঞ্জী। তাঁর রেওয়াজ শুনেছি তখন তাহলে। কিন্তু এ কেমন রেওয়াজ। বার বার একই গান গেয়ে যাওয়া। এবাড়ির সবই অদ্ভুত। তবে এনার নিপুনতা অবাক করার মতো। প্রত্যেক বার একই রকম, একই ভঙ্গী। ভুল করেও সুরটা কোথাও একচুল সরে যাচ্ছেনা। দম নেওয়া, দম ছাড়াও একদম মাপা। সূক্ষ্ণতম পার্থক্যও নেই। শুনলে সত্যিই মনে হয় রেকর্ড বাজছে। তবলারও প্রত্যেকবার একই ঠেকা; সারেঙ্গীরও একই তান। এই নিয়ে একুশ বার শুনলেও এবারেরটা সবথেকে ভালো লাগছে। অসাধারণ পরিবেশনা, সাবলীল সুর সঞ্চালন। মোহিত করে দেয়। ঠুমরীর পর এবার দাদরা – লয়টা একটু দ্রুত। সারেঙ্গীর ছড়ের টানে বুকটা মুচড়ে মুচড়ে উঠছে। অসাধারণ ভালোলাগা। বর্ষার রাতে রাজবাড়ির রাজসভায় বসে এরকম উৎকৃষ্ট সঙ্গীতের আস্বাদন – সারাজীবনের এক অমূল্য স্মৃতি হয়ে থেকে যাবে এই রাতের রাজা সাজা।
তবে বাঙালীর কান। গান বাজনার কাছাকাছি এলেই রবীন্দ্রসংগীতের জন্য মনটা উতলা হয়ে পড়ে। মুখ ফুটে কিছু বলতে হল না। এবাড়ির সকলেই মন পড়ে ফেলতে পারে। সঙ্গীত সাধিকা আমার মনের ভাব বুঝেই দাদরার পর এবার ধরেছেন একটা টপ্পা, রবীন্দ্রসঙ্গীত। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত যাঁরা চর্চা করেন তাঁদের রবীন্দ্রসঙ্গীতের এই ধারাতেই সাবলীল যাতায়াত। আর আমায় একদম অবাক করে দিয়ে, আমার সবথেকে পছন্দের গানটা এখন তাঁর গলায় – “আমি রূপে তোমায় ভোলাব না”। একরাতে এতো ভালোলাগা যে মানুষ পেতে পারে তা আমার সত্যি জানা ছিলনা। যখন ঠূমরী, দাদরা গাইছিলেন, তখন তাঁর গলাটা ছিল একরকম – ধরা ধরা, মাজা মাজা; টিপিক্যাল ক্লাসিক্যাল। কিন্তু এখন যেন মিষ্টি সুরের ঢল নেমেছে গলায়। চোখ বুজে শুনলে মনে হচ্ছে স্বর্গত কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং এসেছেন গান শোনাতে। একই গলায় এরকম সুরের বৈপরীত্য যে অভাবনীয়। এযে কখনোই হতে পারেনা। সারেঙ্গীতেও এখন এসরাজের সুর। এবার আমার সন্দেহ হচ্ছে। মনের ভেতরের আমিটা যেন বলছে এসব কিছুই সত্যি নয়। বিরাট একটা গোলমাল রয়েছে কোথাও। কোনাভাবেই সুস্থ স্বাভাবিক নয় ব্যপারটা। আমার কান দুটো গরম হয়ে উঠছে। কপালে জমছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। একটা ভীষণ অস্বস্তি সারা শরীর জুড়ে। আমি আর তাকিয়ে থাকতে পারছিনা। জ্বালা করছে চোখগুলো। ঝলমলে পোশাক আমার চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। আপনা আপনিই বুঝে আসছে চোখের পাতা। গানটা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। একদম আমার সামনে এসে তীব্র কোলাহল তুলেছে। মিষ্টি সুরটা এখন যান্ত্রিক, ধাতব লাগছে আমার কাছে। কর্কশ শব্দের তীক্ষ্ণ ছোরা আমূল বিদ্ধ হচ্ছে আমার কানের পর্দায়। আমার হাত দুটোতেও এখন পাষাণভার। চেয়ারের হাতলের সাথে যেন কেউ শক্ত করে বেঁধে রেখেছে। হাত দুটো তুলে কানে চাপা দেওয়ার ক্ষমতাও এখন আর আমার নেই। আমার এতো পছন্দের গানটা যেন এখন আমাকেই খুন করতে উদ্যত। আর এই নিষ্ঠুর বাঈজী আমার চেয়ারের চারিপাশে ঘুরে ঘুরে, পায়ের ভারী নুপুরের তালে তালে, ইনিয়ে বিনিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গেয়ে চলেছে গানটার প্রথম দুটো লাইন। এ যে অসহ্য। আমার কান ভোঁ ভোঁ করছে। আমি আর এই গানটাকে সহ্য করতে পারছিনা। বদ্ধ কালা হয়ে গেলে আমি বাঁচি এখন। ধীরে ধীরে চেতনাও যেন লোপ পাচ্ছে। এখানেই, এই গানের অত্যাচারেই এবার আমি মারা পড়ব।
কিন্তু এভাবে শেষ হয়ে যাবো। এতো সহজে। কিছুতেই না। কিছুতেই না। জলে ডোবা মানুষ যেমন বাঁচার তাগিদে শেষমূহুর্তে আঁকড়ে ধরে তৃণ খণ্ড; তেমনি আমিও সর্বশক্তি দিয়ে শেষ বারের মতো চিৎকার করে উঠলাম – “ আর না। আর না। থামো এবার। আমায় মুক্তি দাও। আমই আর পারছিনা।” এর কতোটা যে গলা দিয়ে বেরোল, আর কতোটা যে আটকে থাকল গলাতেই তা বোঝার মতো শক্তি আর আমার রইলনা। তবে গানটা যেন চকিতে ভয় পেয়ে থমকে গেল। হঠাৎ অন্ধকার হয়ে গেল ঘরটা। নূপুরধ্বনি দ্রুত তালে দূরে ফিকে হয়ে এলো। আর আমার চোখে এসে পড়ল এক ঝাঁক জোড়ালো আলো। আমি তখন প্রায় সংজ্ঞাহীন।
কেউ নাড়া দিচ্ছে আমায়। আস্তে আস্তে। এবার জোড়ে। ধাক্কা দিয়ে জাগানোর চেষ্টা করছে আমায়। না আমি আর চোখ খুলবনা। এরকম ভারী চোখের পাতা কষ্ট করে খুলে আমি আর ওই নির্লজ্জ মহিলার মুখ দেখতে চাই না। না না কিছুতেই না। কিছুতেই দেখব না আমি। চোখে মুখে জলের ঝাপটা লাগলো। ঘাড়ে মাথায় কেউ হাওয়া করছে। অনেক দূর থেকে আসা ছেঁড়া ছেঁড়া, ভাসা ভাসা, কিছু কথা যেন শুনতে পারছি। কমলেরই গলা – “সার! সার! উঠে পড়ুন। সব ঠিক হয়ে গেছে। আর কিছু ভয় নেই।” ধীরে ধীরে চোখ খুললাম। খুব সাধারন একটা পুরনো ঘরের অপরিচ্ছন্ন মেঝেতে শুয়ে আছি। ধুলো ময়লার গন্ধ ঘর জুড়ে। জাঁক জমকের কোন চিহ্ন নেই। এতক্ষণ দেখা সেই উজ্জ্বল দৃশ্যপটে কে যেন এক টিন আলকাতরা ছুঁড়ে দিয়েছে। এখন আলো বলতে শুধুমাত্র কমলের হাতে ধরা টর্চ। কমল এখনও বলে চলেছে – “ কতক্ষণ ধরে খোঁজাখুঁজি চলছে। কোথাও না পায়ে শেষে ফোন করা হল। কতোবার। বেজেই চলেছে। ধরেন না কিছুতেই। ঠিক তখনই বুঝিচি , এই শয়তানীর জালেই আটকিচেন। একটু চোখের আড়াল করিচি আর টেনে এনেছে…..” রাগে, ঘৃণায় কমলের মুখে এখন অশ্রাব্য সম্বোধনের ফুলঝুরি ফুটছে। কান পাতা দায়। ফোনটা পকেট থেকে বের করে দেখলাম দশটা বাজতে পাঁচ। পনেরোটা মিসড কল। আবার কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘রুপে তোমায় ভোলাব না’ বাজছে। এটা আমার ফোনের রিঙটোন। আর ফোনের কলার স্ক্রীনে এখন স্ত্রী স্বাতীর মুখ ।
(পরে ভেবে দেখেছি, ঘটনাটি আমার অনুভব ও ভাবনার সাথে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে দেখা স্বপ্নের মিশ্রণ মাত্র, রাজকীয় আতিথ্য নিতে চাইলে চলে আসুন রাজবাড়ী তে ছুঁয়ে দেখুন,অনুভব করুন,৩০০ বছরের প্রাচীন রাজকীয় ইতিহাস কে )
ইতিহাসিক তথ্যসূত্রঃ বঙ্গ সংস্কৃতির ইতিহাস ও গুগল সৌজন্যে

Tuesday, 10 October 2017

তুলসী একটি চমকপ্রদ বৃক্ষ

তুলসী পাতার চমকপ্রদ কিছু গুণ

1. মানসিক চাপে অ্যান্টিস্ট্রেস এজেন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, মানসিক অবসাদ প্রশমনে এমনকি প্রতিরোধে তুলসী চমৎকার কাজ করে। কোনো সুস্থ ব্যক্তি যদি প্রতিদিন অন্তত ১২টি তুলসীপাতা দিনে দু’বার নিয়মিত চিবাতে পারেন তাহলে সেই ব্যক্তি কখনো মানসিক অবসাদে আক্রান্ত হবেন না বলে গবেষকরা জানিয়েছেন। কর্টিসলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রেখে মানসিক চাপ কমিয়ে আনতে সাহায্য করে তুলসি পাতা। স্নায়ু শিথিল করে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে, যা মানসিক চাপ সৃষ্টিকারী ফ্রি রেডিকলকে নিয়ন্ত্রণ করে। অতিরিক্ত অবসাদ এবং মানসিক চাপ অনুভূত হলে ১০ থেকে ১২টি তুলসী পাতা চিবিয়ে খেয়ে নিন, উপকৃত হবেন।তুলসীর স্ট্রেস কমানোর ক্ষমতা আছে। সুস্থ মানুষও প্রতিদিন ১২ টি তুলসী পাতা চিবালে স্ট্রেস মুক্ত থাকতে পারবেন।

2. রক্তের ইউরিক এসিড-এর লেভেলকে কমতে সাহায্য করে কিডনিকে পরিষ্কার করে তুলসী পাতা। তুলসীর অ্যাসেটিক এসিড এবং  এসেনশিয়াল অয়েল এর উপাদান গুলো কিডনির পাথর ভাঙতে সাহায্য করে ও ব্যাথা কমায়। কিডনির পাথর দূর করার জন্য প্রতিদিন তুলসী পাতার রসের সাথে মধু মিশিয়ে খেতে হবে। এভাবে নিয়মিত ৬ মাস খেলে কিডনি পাথর দূর হবে।

3. চর্মরোগে তুলসী পাতা দূর্বাঘাসের ডগার সংগে বেটে মাখলে ভালো হয়ে যায়।

4. উচ্চ রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল কমিয়ে হূৎপিণ্ডের রক্ত সরবরাহের মাত্রা ঠিক রাখতে সাহায্য করে। লিভারের কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়।

5. অজীর্ণজনিত পেট ব্যথায় তুলসী পাতার বেশ উপকার সাধন করে থাকে। এটি হজমকারক। প্রতিদিন সকালে ১৮০ গ্রাম পরিমান তুলসী পাতার রস খেলে পুরাতন জ্বর, রক্তক্ষয়, আমাশয়, রক্ত অর্শ এবং অজীর্ণ রোগ সেরে যায়।

6. হাড়ের গাঁথুনিতে ব্যথা দূর করে এবং শরীরের কাটাছেঁড়া দ্রুত শুকাতে অবদান রাখে।

7. ঠাণ্ডা মরসুমে ছোট বাচ্চাদের তুলসির পাতা খাওয়ালে কৃমি দূর হবে এবং মাংসপেশি ও হাড় হবে শক্তিশালী।

8. জ্বর হলে পানির মধ্যে তুলসী পাতা, গোল মরিচ এবং মিশ্রী মিশিয়ে ভাল করে সেদ্ধ করে নিন ৷ অথবা উপরিউক্ত তিনটে দ্রব্য মিশিয়ে বড়ি তৈরি করুন ৷ দিনের মধ্যে তিন-চার বার ঐ বড়িটা পানি দিয়ে সেবন করুণ । জ্বর খুব তাড়াতাড়ি সেরে যাবে।

9. কাশি হলে তুলসী পাতা এবং আদা একসাথে পিষে মধুর সঙ্গে মিশিয়ে খান ৷ এতে উপকার পাবেন ৷

10. ডাইরিয়া হলে ১০ থেকে বারোটি পাতা পিষে রস খেয়ে ফেলুন।

11. মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে দিনে ৪-৫ বার তুলসী পাতা চেবান ।

12. আপনার শরীরে যদি কোনরকম ঘা যদি থাকে তাহলে তাহলে তুলসী পাতা এবং ফিটকিরি একসঙ্গে পিষে ঘা এর স্থানে লাগান।

13. শরীরের কোন অংশ যদি পুড়ে যায় তাহলে তুলসীর রস এবং নারকেলের তেল ফেটিয়ে লাগান, এতে জ্বালাপোড়া কমে যাবে। পোড়া জায়গাটা তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যাবে এবং পোড়া দাগ ওঠে যাবে।

14. ত্বকের রোশনি বাড়ানোর জন্য, ত্বকের বলীরেখা এবং ব্রোন দূর করার জন্য তুলসী পাতা পিষে মুখে লাগান।

15. প্রস্রাবের জ্বালাপোড়া দূর করতে হলে তুলসী পাতার রস ২৫০ গ্রাম দুধ এবং ১৫০ গ্রাম জলের মধ্যে মিশিয়ে পান করুন । তুলসি গাছের বীজও যথেষ্ট উপকারী। এর বীজ শুকিয়ে মিহি করে খেলে প্রস্রাবের ইনফেকশনজনিত সমস্যা ভালো হয়। পুরুষত্বহীনতা দূরীকরণে এই পাতার অবদান অপরিহার্য।

16. যদি কখনও বমি কিংবা মাথা ঘোরা শুরু করে, তাহলে তুলসী রসের মধ্যে গোলমরিচ মিশিয়ে খেলে বিশেষ উপকার পাওয়া যায়।

17. সকালবেলা খালি পেটে তুলসী পাতা চিবিয়ে রস পান করলে খাবার রুচী বাড়ে।

18. নিয়মিত তুলসীর রস পানে হৃদরোগেও উপকার পাওয়া যায়।

19. চোখের সমস্যা দূর করতে রাতে কয়েকটি তুলসী পাতা পানিতে ভিজিয়ে রেখে ওই পানি দিয়ে সকালে চোখ ধুয়ে ফেলুন।

20. তুলসীতে Eugenol অধিক পরিমাণে থাকায় তা Cox-2 Inhibitor রূপে কাজ করে বলে তা ব্যথানাশক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

21. Hypoglycemic drugs এর সাথে তুলসী খেলে তা টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগে দ্রুত গ্লুকোজের মাত্রা কমিয়ে দেয়।

22. তেজস্ক্রিয়তার ফলে ক্ষতিগ্রস্থ কোষসমুহকে মেরামত করে।

23. চর্বিজনিত হৃদরোগে এন্টি অক্সিডেন্টের ভুমিকা পালন করে।

24. তুলসী একশেরও বেশি Phytochemicals (যেমন oleanolic acid, beta caryophyllene ইত্যাদি)বহন করে বলে ক্যান্সার চিকিত্সারয় ব্যবহৃত হয়।

25. তুলসীর অ্যালকোহলিক নির্যাস Immune system এর রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে।

26. তুলসী স্নায়ুটনিক ও স্মৃতিবর্ধক।

27. শ্বসনতন্ত্রের বিভিন্নরোগ যেমন ব্রঙ্কাইটিস, ইনফ্লুয়েঞ্জা, হাঁপানি প্রভৃতি রোগের নিরাময়ক।

28. সর্দি, কাশি, জ্বর, বমি, ডায়ারিয়া, কলেরা, কিডনির পাথর, মুখের আলসারসহ চোখের বিভিন্ন রোগে ইহা ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

29. পেট খারাপ হলে তুলসীর ১০ টা পাতা সামান্য জিরের সঙ্গে পিষে ৩-৪ বার খান ৷ পায়খানা একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে!

30. তুলসী মূল শুক্র গাঢ় কারক। তুলসী পাতার ক্বাথ, এলাচ গুঁড়া এবং এক তোলা পরিমাণ মিছরী পান করলে ধাতুপুষ্টি সাধিত হয় যতদিন সম্ভব খাওয়া যায়। এটি অত্যন্ত ইন্দ্রিয় উত্তেজক। প্রতিদিন এক ইঞ্চি পরিমাণ তুলসী গাছের শিকড় পানের সাথে খেলে যৌনদূর্বলতা রোগ সেরে যায়।

31. চর্মরোগে তুলসী পাতা দূর্বাঘাসের ডগার সংগে বেটে মাখলে ভালো হয়ে যায়।

Wednesday, 4 October 2017

প্রথম শবব্যবচ্ছেদকারী বাঙালী শল্যচিকিৎসক মধুসূদন গুপ্ত ( জন্মঃ- ১৮০০ - মৃত্যুঃ- ১৫ নভেম্বর, ১৮৫৬ )

১৮৩৬ সালের ২৮শে অক্টোবর। আগের বছর পয়লা জুন প্রতিষ্ঠিত কলিকাতা মেডিকেল কলেজের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় শুরু হতে চলেছে।  সারা কলকাতায় সে এক আলোড়ন সৃষ্টিকারী খবর,এমনকি সারা এশিয়ার চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে প্রথম সংস্কার ভাঙার  খবর। মেডিকেল কলেজের সব ফটকগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, পাছে এই বিধর্মী কাজ বন্ধ করার জন্য প্রাচীনপন্থীরা কলেজে আক্রমণ চালায়! মেডিকেল কলেজের শব রাখার ঘরে ভিড়,উপস্থিত রয়েছেন মেডিকেল কলেজের সব ইংরেজ অধ্যাপক ডাক্তাররা, সঙ্গী ছাত্রবন্ধুরা ভিড় করে দাঁড়িয়েছে ঘরের বাইরের দরজায়,ঘরের ঝিলমিলের ফাঁকে ফাঁকে চোখ রেখে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে অনেকে। সারা ক্যাম্পাস ফাঁকা, সবাই শবঘরের কাছে ভিড় করে এসেছে। নির্দিষ্ট সময়ে ডাক্তার গুডিভের সঙ্গে দৃপ্তপদে ঘরে ঢুকলেন একদা সংস্কৃত কলেজের আয়ুর্বেদ বিভাগের ছাত্র পন্ডিত মধুসূদন গুপ্ত। বর্তমানে পণ্ডিত গুপ্ত একই সঙ্গে মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ও ছাত্র । ডাক্তারী শাস্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ সার্জারি, যা ভারতে এখনও করানো সম্ভব হয়নি, শব ব্যবচ্ছেদ নিয়ে বর্ণহিন্দুদের গোঁড়া কুসংস্কারের জন্য, সেই কাজটিই আজ করতে এসেছেন পন্ডিত মধুসূদন, হাতে তাঁর একটি শব ব্যবচ্ছেদ করার তীক্ষ্ণ ছুরি।
তাঁর সঙ্গে  যোগ দেবার জন্য দলে নাম ছিল উমাচরণ শেঠ, রাজকৃষ্ণ দে, দ্বারকানাথ গুপ্ত ও নবীন চন্দ্র মিত্রের। কিন্তু তাঁরা দরজার  বাইরেই ভিড় করে দাঁড়িয়ে রইলেন।
ঘরে ঢুকে মধুসূদন বিনাদ্বিধায় এগিয়ে গেলেন শবের দিকে। শবদেহের নির্ভুল জায়গায় ছুরিটি প্রবেশ করালেন তিনি। মুখে কোনও আড়ষ্টতা বা অস্থিরতার চিহ্ন নেই। খুব নিখুঁতভাবে আর সুন্দরভাবে বিনাদ্বিধায় সম্পন্ন করলেন ব্যবচ্ছেদের কাজ। ভারতবর্ষের চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে বিজ্ঞানী শুশ্রূতের পরে এই প্রথম হল শবব্যবচ্ছেদ। দীর্ঘকালের কুসংস্কারের আর গোঁড়া পন্ডিতদের বাধানিষেধের বেড়া ভেঙে দিলেন তিনি এই একটি কাজের মাধ্যমে। নিষেধের জগদ্দল ভার সরিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানে ভারত এক নতুন যুগে প্রবেশ করল।   
মধুসূদন গুপ্ত ছিলেন হুগলী জেলার বৈদ্যবাটি গ্রামের এক বৈদ্য পরিবারের সন্তান। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক এই পরিবারের সমাজে খুব নামডাক ও প্রতিপত্তি ছিল। তাঁর প্রপিতামহ ‘বকশি’ উপাধি পেয়েছিলেন আর পিতামহ ছিলেন হুগলীর নবাব পরিবারের গৃহচিকিৎসক।তাঁর জন্ম সম্ভবত ১৮০০ সালে, যে বছর ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের প্রতিষ্ঠা হয় কলিকাতায়। ছেলেবেলায় খুব দুরন্ত মধুসূদনের প্রথা বিরোধী কাজকর্মেই উৎসাহ ছিল বেশি। প্রথাগত লেখাপড়ায় তাঁর ছিল একান্ত অনীহা। কোনও উচ্চাশা ছিলনা। শোনা যায় লেখাপড়ায় অমনোযোগী কিশোর মধুসূদনকে তাঁর পিতা বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন।
এর পরবর্তী কিছুদিনের কথা বিশেষ জানা যায়না।তাঁকে আবার দেখা গেল ১৮২৬সালে ডিসেম্বরে সংস্কৃত কলেজের সদ্যস্থাপিত বৈদ্যক(আয়ুর্বেদ) বিভাগের ছাত্র হিসাবে।সংস্কৃত কলেজে ব্যাকরণ, ন্যায়, কাব্য ,অলঙ্কার,সাহিত্য পাঠের সঙ্গে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রেও অসামান্য ব্যুৎপত্তি দেখান তিনি। অসামান্য মেধার অধিকারী মধুসূদন গুপ্ত নিজের পারদর্শিতায় অল্পদিনের মধ্যেই ক্লাসের একজন নামকরা ছাত্র হয়ে উঠলেন।সংস্কৃত কলেজে আয়ুর্বেদিক ক্লাসের প্রশিক্ষণের সময় তিনি (কাঠ বা মোমের তৈরি) মানুষের হাড়গোড় খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করতেন,কখনও নিজেই ছোট ছোট জীবজন্তু ব্যবচ্ছেদ করে অভিজ্ঞতা ও সাহস সঞ্চয় করেছিলেন।এইসময় কলেজে ইংরেজিতে লেখা ডাক্তারি বই আরবি ও সংস্কৃতে অনুবাদ করে ছাত্রদের বোধগম্য করানো হত।এসব বইই তিনি নিজে থেকে পড়ে ফেলেছিলেন।
তাঁর অভিজ্ঞতার বহর ও পারদর্শিতা কলেজ কর্তৃপক্ষের নজর এড়ায়নি।তাঁর পারদর্শিতার জন্য সংস্কৃত কলেজের এই বিভাগের অধ্যাপক খুদিরাম বিশারদ অসুস্থ হয়ে পড়াতে বৈদ্যক শ্রেণীর কৃতি ছাত্র মধুসূদন গুপ্তকে ১৮৩০ সালের মে মাস থেকে সেই পদে নিয়োগ করা হয়, ও অধ্যাপকের কাজের জন্য মাসিক ৩০ টাকা বেতন নির্ধারিত হয়। সহপাঠী ছাত্র মধুসূদনের অধ্যাপক পদ প্রাপ্তিতে ছাত্রদের মধ্যে বিশেষ অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল। কিন্তু তাঁর পাঠদানের দক্ষতায় সেই অসন্তোষ অচিরেই দূর হয়ে যায়। কারণ তাঁর দক্ষতা।
১৮৩২ সালের প্রথমেই সংস্কৃত কলেজের লাগোয়া একতলা একটি বাড়িতে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়, স্থানীয়দের চিকিৎসা আর ওষুধপত্র দানের জন্য। সংস্কৃত কলেজের মেডিক্যাল লেকচারার জ়ে গ্রান্ট সাহেব,ও ডাঃ টাইটলার এই নতুন কলেজবাড়িতে এসে ক্লাস নিতেন ও চিকিৎসা বিষয়ে বিশেষতঃ অ্যানাটমি আর মেডিসিনের তত্ত্ব এবং প্রয়োগ বিষয়ে সারগর্ভ  বক্তৃতা দিতেন। মধুসূদন নিয়মিত মনোযোগ দিয়ে সেই বক্তৃতা শুনতেন। ফলে পান্ডিত্যে তিনি সহপাঠীদের থেকে অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছিলেন। কলিকাতা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার পর ১৮৩৫ সালে স্ংস্কৃত কলেজের বৈদ্যক বিভাগ বন্ধ হয়ে যায় আর ছাত্ররা সব মেডিক্যাল কলেজের ক্লাসে যোগ দেয়। আর ছাত্র মধুসূদনও ১৮৩৫ সালের ১৭ই মার্চ থেকে মেডিকেল কলেজের ডিমনস্ট্রেটরের কাজে নিযুক্ত হন ও সহকারী অধ্যাপকের পদে কাজ করতে থাকেন।কিন্তু একজন সহপাঠীর কাছে পাঠ নিতে ছাত্ররা আপত্তি করে। তাদের আপত্তির কারণ ছিল মধুসূদন তখনও ডাক্তারী পাশ করেননি, তিনি সামান্য কবিরাজ মাত্র। এই আপত্তি জোরালো হলে কলেজের কাজে অসুবিধা দেখা দেবে, কেননা কবিরাজ হলেও তিনি ডাক্তারি বিষয়ে যথেষ্ট দক্ষ। তাই ছাত্রদের অসন্তোষ প্রশমনের জন্য কলেজের কর্তৃপক্ষ পাশ করা ডাক্তারের ডিগ্রি নেবার জন্য তাঁকে ডাক্তারী পরীক্ষার চূড়ান্ত পরীক্ষা দিতে বলেন। তিনি রাজি হয়ে যান ও ডাক্তারী পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়ে কবিরাজ থেকে ডাক্তারে পরিণত হন।
আসলে ছয় বৎসর সংস্কৃত কলেজে ও ইংরাজির ক্লাস করার আগে থেকেই তিনি দেশীয় পদ্ধতিতে রোগনির্ণয়, নিদান দিতে শিখেছিলেন ‘কেবলরাম কবিরাজ’ নামে একজন অভিজ্ঞ দেশীয় কবিরাজের কাছে। সে সময়ে তিনি কবিরাজ গুরুর নির্দেশে গ্রামে গ্রামে রুগী দেখতেও যেতেন। তাছাড়া ইংরেজ শিক্ষকদের বক্তৃতাগুলি নিষ্ঠার সঙ্গে শুনেছেন পাঁচবছর ধরে, সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে শেষের দুটি বছর তাঁকে সাহেব ডাক্তাররা সহকারী করে নিয়েছিলেন। তখন তাঁর কাজ ছিল নিজে বক্তৃতা শোনার সাথে সাথে, দেশীয় ছাত্রদের ইংরেজি শব্দগুলিকে সংস্কৃতে ও বাংলায় তর্জমা করে দিতেন। কেবলরাম কবিরাজের সহযোগী হিসাবে কাজ করার সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রামে ঘুরেছেন, আর সেখানকার মানুষের অসুবিধা রোগের কারণ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন।কলকাতায় বিখ্যাত সার্জন জেমস রেনাল্ড মার্টিন যখন দেশের মানুষদের স্বাস্থ্য আর ম্যালেরিয়া জ্বরের প্রকোপ বন্ধ করতে তৎপর হয়েছিলেন এবং কলিকাতার সমস্ত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে ১৯৩৫ সালে এক সাধারণ মিটিং ডাকেন, আর ‘জেনারেল কমিটি অফ দি ফিভার হসপিটাল এন্ড মিউনিসিপ্যাল ইমপ্রুভমেন্ট”-এর প্রতিষ্ঠা করেন, তখন প্রথমেই যোগ্য ব্যক্তি হিসাবে মধুসূদন গুপ্তকে তলব করেন ও তাঁর পরামর্শে কমিটির কাজকর্ম শুরু হয়। এই মিটিঙেই তাঁর সকল অভিজ্ঞতার কথা জানা যায় ও তাঁর মূল্যবান পরামর্শ গ্রহণ করা হয়। তাঁর  পরামর্শ মোতাবেক গড়ে ওঠে ‘হিন্দু ধাত্রী’ কর্মচারীদল গঠনের পরিকল্পনা যাতে বহু হিন্দু মেয়ের কর্মসংস্থান হয়, রাস্তাঘাট পরিষ্কারের নতুন পরিকল্পনা নেওয়া হয়, বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়, নিকাশী ব্যবস্থার সংস্কারের পরিকল্পনা নেওয়া হয়।(তিনি বিভিন্ন বাজার এলাকার আবর্জনা ভর্তি অবস্থা, ঘনবসতি এলাকার মানুষের নানা অসুবিধার কথা প্রত্যক্ষ দর্শনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ব্যক্ত করেছিলেন কমিটির সদস্যদের সামনে)।      
তাঁর সকল কার্যকলাপ, জ্ঞান আর পরীক্ষায় চূড়ান্ত সফলতার অভিজ্ঞান হিসাবে  ১৮৪০ সালের ২৬শে নভেম্বর মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁর ডাক্তারীর চূড়ান্ত পরীক্ষার উত্তরপত্রটির ব্যাপারে এই মর্মে একটি সংশাপত্র দেন যে, “বৈদ্যবাটীর মধুসূদন গুপ্তর উত্তরপত্রটি যত্ন করে পরীক্ষা করে বুঝেছি যে শারীরসংস্থান,শারীরবৃত্ত, রসায়ন ,মেটিরিয়া মেডিকা ইত্যাদিতে তাঁর অসামান্য জ্ঞান আর ঔষধ, শল্যচিকিৎসা ও তার ব্যবহারিক প্রয়োগক্ষমতা বিষয়ে তাঁর দক্ষতা সংশয়াতীত।”
মেডিকেল কলেজে একটি হিন্দুস্থানী বিভাগ ছিল। ১৮৪৩-৪৪ সালে এই বিভাগটি ঢেলে সাজানো হয়, ও সেটির সুপারিন্টেন্ডেন্ট নিযুক্ত করা হয় মধুসূদন গুপ্তকে। এরপরে ১৮৫২ সালে বাংলা  বিভাগ খোলা হলে তার দায়িত্বও তাঁকে দেওয়া হয়। ১৮৫৬ সালে  মৃত্যু পর্যন্ত তিনি (২২ বছর)মেডিকেল কলেজের এই পদে বহাল ছিলেন।  
শুধুমাত্র শিক্ষাদানের কাজ ছাড়াও তাঁর দুটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল ‘লন্ডন ফার্মাকোপিয়া’ (১৮৪৯ সালে)  আর ‘অ্যানাটমি’(১৮৫৩ সালে) নামে বই দুটির ইংরাজি থেকে বাংলা অনুবাদ করা। এই সময়েই ১৮৪৯ সালের ২৭শে জুন তিনি ‘ফার্স্ট ক্লাস সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জন’ পদে উন্নীত হন। সংস্কৃত কলেজে পড়ার সময়ই তিনি হুপারের লেখা “Anatomist’s Vade Mecum”  নামে  বইটির সংস্কৃত অনুবাদ করে ১০০০ টাকা পুরস্কার পেয়েছিলেন।
কলিকাতার জনস্বাস্থ্য, পানীয় জলের স্বচ্ছতা,  পরিবেশ পরিচ্ছন্নতা, টিকাকরণের ব্যবস্থা প্রভৃতি জনসমস্যা  বিষয়ে তাঁর বিশেষ নজর ছিল।কমিটিতে সে বিষয়ে তিনি মূল্যবান পরামর্শও দিয়েছিলেন।  
নিজে ছিলেন ডায়াবেটিক রোগী। কিন্তু বারণ না শুনে জীবাণু সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়েও অনবরত শবব্যবচ্ছেদ করতেন অন্যদের একাজে সাহস যোগাতে। জীবাণু সংক্রমণে ডায়াবেটিক সেপ্টিসিমিয়াতে আক্রান্ত হয়ে ১৮৫৬ সালের ১৫ই নভেম্বর এই মহাপ্রাণের মৃত্যু হয়।
আজ মেডিকেল কলেজ কত উন্নত হয়েছে, দেশ এগিয়েছে, কিন্তু ভারতীয় সার্জারির ইতিহাসের দ্বার খুলে দেওয়ার এই পথপ্রদর্শকের কথা কি সেভাবে মনে রেখেছি আমরা? আজ তাঁর সেই অবদানের সম্মানার্থে এই সামান্য তথ্যটুকু পরিবেশন করলাম , হয়ত যারা জানেনা তারা তাঁকে জানবে ,স্মরণ করবে বাংলা মায়ের এই নিঃস্বার্থ সন্তানকে।

Sunday, 1 October 2017

আমাদের পাশের জেলা ব

বাঁকুড়া জেলার ইতিহাস
বাঁকুড়া জেলার ইতিহাস বলতে বোঝায় পশ্চিমবঙ্গের অধুনা বাঁকুড়া জেলা নামে পরিচিত ভূখণ্ডের ইতিহাস।

প্রাচীন কালে বাঁকুড়া জেলা সুহ্মভূমি অঞ্চলের অন্তর্গত ছিল। মহাভারত-এ আছে, ভীম সুহ্মভূমির রাজাকে পরাজিত করেছিলেন। মহাভারত-এর টীকা রচয়িতা নীলকণ্ঠ সুহ্মভূমিকের "রাঢ়া" (রাঢ়) নামে চিহ্নিত করেছেন। জৈন ধর্মগ্রন্থ আচারাঙ্গ সূত্র-এ রাঢ় অঞ্চলকে বলা হয়েছে "লাঢ়"। ঐতিহাসিকদের মতে, খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে "সুহ্ম" শব্দটি থেকেই প্রথমে "লাঢ়" ও পরে "রাঢ়" শব্দটির উৎপত্তি হয়। বাঁকুড়া সদর মহকুমার শুশুনিয়া পাহাড়ে একটি সংস্কৃত শিলালিপি পাওয়া গিয়েছে। এটি খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে রাজা চন্দ্রবর্মণ খোদাই করিয়েছিলেন। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে রঘুনাথ মল্ল মল্ল রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। সেই সময় থেকে বাঁকুড়া জেলা "মল্লভূম" নামে পরিচিত হয়। এরপরই বাঁকুড়া অঞ্চলের আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ দ্রুত ঘটতে থাকে। বিষ্ণুপুর মহকুমার সদর শহর বিষ্ণুপুরে (সেই সময় "বন-বিষ্ণুপুর" নামে পরিচিত ছিল) মল্লভূম রাজ্যের রাজধানী স্থাপিত হয়। মল্ল রাজবংশ প্রায় ১০০০ বছর এই অঞ্চল শাসন করেছিল এবং প্রজাহিতৈষী রাজবংশ হিসেবে সুনাম অর্জন করেছিল। ১৭৬৫ সালে দেওয়ানি লাভের পর বিষ্ণুপুর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে আসে। পরে মরাঠা আক্রমণ ও ১৭৭০ সালের মন্বন্তরে এই অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক কাঠামো সম্পূর্ণ নষ্ট হয়। ১৭৮৭ সালে বিষ্ণুপুর ও বীরভূম জেলাদুটি সংযুক্ত করে একই জেলায় পরিণত করা হয়। ১৭৯৩ সালে বিষ্ণুপুরকে বীরভূম জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে বর্ধমান জেলার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। ১৮০৫ সালে বিষ্ণুপুরকে জঙ্গলমহল জেলার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। ১৮৩৭ সালে বাঁকুড়াকে সদর করে ও বিষ্ণুপুরকে পৃথক করে পশ্চিম বর্ধমান জেলা গঠন করা হয়। ১৮৮১ সালে বর্তমান বাঁকুড়া জেলা স্থাপিত হয়।

প্রাগৈতিহাসিক যুগ
বাঁকুড়া অঞ্চলের প্রাচীনতম মানব বসতির নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে দিহারে। ১০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ নাগাদ ক্যালকোলিথিক মানবগোষ্ঠী দ্বারকেশ্বর নদের উত্তর তীরে বসতি স্থাপন করেছিল। প্রাগৈতিহাসিক যুগের শেষভাবে বিভিন্ন প্রোটো-অস্ট্রালয়েড ও কয়েকটি প্রোটো-দ্রাবিড় উপজাতি এখানে বসতি স্থাপন করে। এই সব উপজাতি খাদ্যসংগ্রহ, শিকার, পশুপালন ও চাষবাস করত। প্রাচীন কালে বাঁকুড়া জেলা ছিল রাঢ় অঞ্চলের অন্তর্গত। বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় এই অঞ্চলে আদিবাসী জনজাতির সংখ্যা অধিক ছিল। প্রোটো-ইন্দো-আর্য গোষ্ঠীর মানুষেরা এই অঞ্চলের আর্যীকরণ করে। এই জাতির মানুষেরা উত্তর ভারত থেকে বাংলায় এসেছিল। এখানে দুটি প্রধান জাতিগোষ্ঠী ছিল - নিষাদ (প্রোটো-অস্ট্রালয়েড উপজাতি) ও দাস-দস্যু (দ্রাবিড় জাতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত)। উপগোষ্ঠীগুলির অন্তর্গত ছিল বাগদি, বাউড়ি, জেলে, হাড়ি, ডোম ও অন্যান্যরা। সাঁওতাল ও মাল পাহাড়িয়ারা সম্ভবত প্রথম থেকেই এই অঞ্চলের বাসিন্দা।  খাদ্য, পোষাকপরিচ্ছদ, ধর্ম, আচরণ ও অন্যান্য বিষয়ে বিভিন্ন উপজাতিগুলির মধ্যে পার্থক্য ছিল এবং এদের পরস্পরের মধ্যে মেলামেশা ছিল না, স্বজাতির বাইরে বিবাহ সম্পর্ক স্থাপন তো দূরের কথা।

আর্যীকরণ
প্রোটো-ইন্দো-আর্যরা এখানে এলে ধীরে ধীরে এই অঞ্চলের আর্যীকরণ শুরু হয়। প্রথম দিকে গুণ ও কর্মের বিভাগ অনুযায়ী এই আর্যীকরণ শুরু হয়। এর ফলে এই অঞ্চলে বর্ণভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়ে ওঠে। এই সমাজব্যবস্থা গড়ে ওঠার পিছনে এই অঞ্চলের পুরনো সমাজব্যবস্থারও কিছু অবদান ছিল। তবে এই আর্যীকরণ সহজে হয়নি। কয়েক শতাব্দী ধরে সংঘর্ষ ও সহযোগিতা উভয় পরিবেশেই ধীরে ধীরে আর্যীকরণের কাজ সম্পাদিত হয়েছে। ঐতরেয় আরণ্যক গ্রন্থে (আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দী) এই অঞ্চলের অধিবাসীদের অসুর নামে অভিহিত করা হয়েছে। আজও এই জেলার বহু গ্রামের নাম অসুর-দের নামের সঙ্গে যুক্ত। বৌধায়ন ধর্মসূত্র গ্রন্থে (আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম-ষষ্ঠ শতাব্দী) বলা হয়েছে, অঙ্গ ও মধ্যদেশে আংশিক আর্যীকরণ সম্পন্ন হলেও, পুণ্ড্র, বঙ্গ ও কলিঙ্গ কেবল উত্তর ভারতের আর্য জাতির সংস্পর্শেই এসেছে। প্রাকৃত ও সংস্কৃত ভাষায় লেখা শুশুনিয়া লেখ থেকে জানা যায়, খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে রাজা চন্দ্রবর্মণের পুত্র সিংহবর্মণ পুষ্করণের (অধুনা পোখরনা) রাজা ছিলেন। প্রায় সমগ্র রাঢ় (দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলা) তাঁর শাসনাধীনে ছিল। এলাহাবাদ প্রশস্তি থেকে জানা যায়, সমুদ্রগুপ্ত চন্দ্রবর্মণকে পরাজিত করে এই অঞ্চলটি গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধিভুক্ত করেছিলেন। বহু বছর এই অঞ্চল বর্ধমানভুক্তি ও দণ্ডভুক্তির অধীনস্থ ছিল। আচারাঙ্গ সূত্র নামক প্রাচীন জৈন গ্রন্থে (আনুমানিক খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দী) সুহ্ম ও লাঢ়া (রাঢ়?) অঞ্চলের উল্লেখ রয়েছে। উক্ত গ্রন্থে এই অঞ্চলদুটিকে বর্বর জাতি অধ্যুষিত বলা হয়েছে। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, বাংলায় আর্যীকরণের কাজ প্রথমে উত্তর ও পূর্ব বাংলায় হয়, এবং তার পরে হয় পশ্চিম বাংলায়। এই সময়েই বাংলায় জৈন ও বৌদ্ধ ধর্ম প্রসার লাভ করে। খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে বাংলায় আর্য ধর্মের প্রসারের একাধিক নিদর্শন পাওয়া গেছে।

বিষ্ণুপুর রাজ্য
খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দী থেকে ব্রিটিশ শাসনের সূচনালগ্ন পর্যন্ত প্রায় এক সহস্রাব্দ কাল বাঁকুড়া জেলার ইতিহাস বিষ্ণুপুরের হিন্দু মল্ল রাজবংশের উত্থান ও পতনের সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে রমেশচন্দ্র দত্ত লিখেছেন, "বিষ্ণুপুরের প্রাচীন রাজবংশের সূচনা সেই সময় ঘটে যখন দিল্লিতে হিন্দু রাজবংশ শাসন করত। সেই সময় ভারতের কেউ মুসলমান সম্প্রদায়ের নাম শোনেনি। বখতিয়ার খিলজি হিন্দু রাজাদের হাত থেকে বাংলার শাসন অধিকার করে নেওয়ার আগে পাঁচ শতাব্দীকাল এই রাজবংশ বিষ্ণুপুর শাসন করেছিল। যদিও, বাংলায় মুসলমান বিজয় বিষ্ণুপুর রাজাদের শাসনের ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন আনেনি... বাংলার উর্বর অংশের মুসলমান শাসকেরা এই অরণ্যরাজ্য সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিলেন না। তারা এই অঞ্চলে কখনও আসেনওনি। এই কারণে, শতাব্দীর পর শতাব্দীকাল বিষ্ণুপুরের রাজারা নির্বিঘ্নে শাসনকাজ চালিয়ে যান। পরবর্তীকালে অবশ্য মুঘল রাজশক্তি এই অঞ্চল পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল। মাঝে মাঝে মুঘল বাহিনী বিষ্ণুপুরের নিকটে এসে রাজস্ব দাবি করত এবং সম্ভবত বিষ্ণুপুরের রাজারা রাজস্ব দিয়েও দিতেন। মুর্শিদাবাদের সুবাদারেরা পরবর্তীকালের বীরভূম ও বর্ধমানের রাজাদের মতো বিষ্ণুপুরের রাজাদেরও নিয়ন্ত্রণে আনতে সম্পূর্ণ সক্ষম হননি। বর্ধমান রাজাদের শক্তিবৃদ্ধি হওয়ার পর বিষ্ণুপুর রাজবংশের অবক্ষয় শুরু হয়। মহারাজা কীর্তিচাঁদ বিষ্ণুপুর আক্রমণ করে এই অঞ্চলের একটি বিস্তৃর্ণ অঞ্চল নিজ জমিদারির অন্তর্ভুক্ত করেন। বর্গী হানার সঙ্গে সঙ্গে বিষ্ণুপুর রাজবংশের পতন সম্পূর্ণ হয়। বর্তমানে এইটি দরিদ্র জমিদার পরিবার মাত্র।" বিষ্ণুপুর রাজাদের উৎস রহস্যাবৃত। বহু শতাব্দীকাল তাঁদের বাগদি রাজা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও বিষ্ণুপুরের রাজারা এবং তাঁদের অনুগামীরা দাবি করেন যে তাঁরা উত্তর ভারতের ক্ষত্রিয় বংশোদ্ভুত। এই অঞ্চলের আর্যীকরণের শেষ পর্যায়ে এই দাবি বিশেষ জোরালো হয়ে ওঠে। বিষ্ণুপুরের রাজারা মল্ল রাজা নামে পরিচিত। সংস্কৃত মল্ল শব্দটির অর্থ মল্লযোদ্ধা। তবে এই শব্দটির সঙ্গে এই অঞ্চলের মাল উপজাতির সম্পর্ক থাকাও সম্ভব। এই উপজাতির সঙ্গে বাগদিদের সম্পর্ক বিদ্যমান। বিষ্ণুপুর-সংলগ্ন অঞ্চলটিকে অতীতে মল্লভূম বলা হত। মল্লভূম রাজ্যের কেন্দ্রীয় এলাকা ছিল বর্তমান বাঁকুড়া থানা এলাকা (ছাতনা বাদে), ওন্দা, বিষ্ণুপুর, কোতুলপুর ও ইন্দাস। তবে প্রাচীন বিষ্ণুপুর রাজ্যের আয়তন আরও বড়ো ছিল। উত্তরে সাঁওতাল পরগনার দামিন-ই-কোহ থেকে এই রাজ্য দক্ষিণে মেদিনীপুর পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। পূর্বে বর্ধমানের পূর্বাঞ্চল থেকে পশ্চিমে ছোটোনাগপুরের একটি অঞ্চলও এই রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই জেলার কিছু অঞ্চল অতীতে আদিবাসী অধ্যুষিত হলেও পরে তাদের ধীরে ধীরে দমন করা হয়। খাতড়া অঞ্চলটি ধলভূম, রায়পুর অঞ্চলটি তুঙ্গভূম ও ছাতনা অঞ্চলটি সামন্তভূম নামে পরিচিত ছিল। মল্ল রাজারা এই সব অঞ্চলও মল্লভূমের অধিকারে আনেন। প্রাচীন লেখগুলিতে বরাহভূমি বা বরাভূমি নামেও (অধুনা বরাভূম) একটি অঞ্চলের উল্লেখ পাওয়া যায়। দারিকেশী নদী ও শেখর পর্বত (সম্ভবত অধুনা পরেশনাথ) এই রাজ্যের সীমা ছিল।

আদিমল্ল
আদিমল্ল ছিলেন মল্ল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। এই রাজবংশের সূচনা সম্পর্কে একটি কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছে। ৬৯৫ খ্রিষ্টাব্দে উত্তর ভারতের এক রাজপুত্র পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে তীর্থ করতে যাচ্ছিলেন। তিনি কোতুলপুর থেকে ৮.৪ কিলোমিটার (৫.২ মাইল) দূরে লাউগ্রামের গভীর অরণ্যে তাঁবু ফেলেন। সেখানেই তাঁর সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে এক ব্রাহ্মণের তত্ত্বাবধানে রেখে যান। রাজার স্ত্রী এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেন এবং তাঁরা লাউগ্রামেই থেকে যান। সাত বছর বয়সে ছেলেটি রাখালের কাজ শুরু করে। তবে অল্প বয়স থেকে তার মধ্যে নেতাসুলভ ভাব লক্ষিত হতে দেখা যায়। সে যোদ্ধা হিসেবে প্রশিক্ষিত হয়। মাত্র পনেরো বছর বয়সেই সে অপ্রতিদ্বন্দ্বী মল্লযোদ্ধা হয়ে ওঠে। এই কারণে সে আদিমল্ল (আদি বা অদ্বিতীয় মল্লযোদ্ধা) নামে পরিচিত হয়। বড়ো হয়ে আদিমল্ল লাউগ্রাম থেকে ১২.৮ কিলোমিটার (৮ মাইল) দূরে অবস্থিত জয়পুরের নিকটস্থ পদমপুরের রাজার কাছ থেকে লাউগ্রাম ও পার্শ্ববর্তী কয়েকটি গ্রামের আধিপত্য অর্জন করেন। এই কাহিনির সত্যতা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকলেও, বিষ্ণুপুরের রাজাদের সঙ্গে ক্ষত্রিয় বংশের সংযোগ নিয়ে এই রকম একাধিক কাহিনি মল্লভূমে প্রচলিত ছিল।
আদিমল্ল ৩৩ বছর লাউগ্রাম শাসন করেন এবং বাগদি রাজা নামে অভিহিত হন। তাঁর পুত্র জয়মল্ল রাজা হয়ে পদমপুর আক্রমণ করে দুর্গ অধিকার করেন। জয়মল্ল তাঁর রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটিয়ে বিষ্ণুপুরে রাজধানী সরিয়ে আনেন। পরবর্তী রাজারাও রাজ্যবিস্তারে মন দিয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন চতুর্থ রাজা কালুমল্ল, ষষ্ঠ রাজা কাউমল্ল ও সপ্তম রাজা ঝাউমল্ল। অষ্টম রাজা সুরমল্ল উত্তর মেদিনীপুরের বাগড়ির রাজাকে পরাজিত করেছিলেন। তাঁর পরে আরও ৪০ জন বিষ্ণুপুর শাসন করেন। এঁরা সকলেই মল্ল বা মল্লবনিনাথ নামে পরিচিত ছিলেন। এই রাজাদের পারিবারিক নথি থেকে জানা যায়, এঁরা বিদেশি শাসনের অধীনতাপাশ থেকে মুক্ত ছিলেন।
বীর হাম্বীর
মল্ল রাজবংশের ৪৯তম শাসক বীর হাম্বীর ১৫৮৬ সালে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ছিলেন মুঘল সম্রাট আকবরের সমসাময়িক। আফগানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি আকবরের পক্ষাবলম্বন করেন। মুসলমান ঐতিহাসিকগণ তাঁর নাম উল্লেখ করেছেন। তিনি বাংলার সুবাদারের নিকট বার্ষিক রাজস্ব প্রদান করতেন এবং মুঘল সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নেন।
বীর হাম্বীর ছিলেন শক্তিশালী ও ধার্মিক রাজা। শ্রীনিবাস আচার্য তাঁকে বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত করেন। নরোত্তম দাস (ওরফে বলরাম দাস) রচিত প্রেমবিলাস ও নরহরি চক্রবর্তী রচিত ভক্তিরত্নাকর গ্রন্থ থেকে জানা যায়, শ্রীনিবাস ও অন্যান্য ভক্তেরা বৃন্দাবন থেকে গৌড় যাত্রাপথে হাম্বীর কর্তৃক লুণ্ঠিত হন। কিন্তু শ্রীনিবাসের ভাগবত পাঠ শুনে তিনি বৈষ্ণবধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এবং শ্রীনিবাসকে প্রচুর অর্থ ও ভূসম্পত্তি দান করেন। তিনি বিষ্ণুপুরে মদনমোহন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
রঘুনাথ সিংহ
বীর হাম্বীরের পুত্র রঘুনাথ সিংহ বিষ্ণুপুরের প্রথম রাজা যিনি ক্ষত্রিয় সিংহ উপাধি ব্যবহার করেন। কথিত আছে, এই উপাধি মুর্শিদাবাদের নবাব তাঁকে প্রদান করেছিলেন। তাঁর রাজত্বকাল থেকেই বিষ্ণুপুর রাজ্যের স্বর্ণযুগের সূচনা ঘটে। রঘুনাথ সিংহের আমলে বিষ্ণুপুরে নয়নাভিরাম প্রাসাদ ও মন্দিরাদি নির্মিত হয়। কথিত আছে, এই সময় বিষ্ণুপুর নাকি ইন্দ্রের স্বর্গপুরীর চেয়েও সুন্দর হয়ে উঠেছিল। যদিও, রাজনৈতিকভাবে বিষ্ণুপুর এই সময় তার স্বাধীনতা হারিয়ে অনেকটাই করদ রাজ্যের পর্যায়ে পর্যবসিত হয়। ১৬৪৩ থেকে ১৬৫৬ সালের মধ্যে রঘুনাথ সিংহ শ্যামরায়, জোড় বাংলা ও কালাচাঁদ মন্দির নির্মাণ করেছিলেন।
বীর সিংহ
১৬৫৬ সালে বীর সিংহ বর্তমান দুর্গ ও লালজি মন্দির নির্মাণ করেন। এছাড়া তিনি লালবাঁধ, কৃষ্ণবাঁধ, গনতাতবাঁধ, যমুনাবাঁধ, কালিন্দীবাঁধ, শ্যামবাঁধ ও পোকাবাঁধ নামে সাতটি বড়ো জলাধারও নির্মাণ করেন। ১৬৬৫ সালে তাঁর মহিষী শিরোমণি বা চূড়ামণি মদনমোহন ও মুরলিমোহন মন্দিরদুটি নির্মাণ করেন। বীর সিংহ তাঁর আঠারো পুত্রকে জন্মমাত্রেই হত্যা করেছিলেন। কনিষ্ঠ পুত্র দুর্জনকে ভৃত্যেরা লুকিয়ে রাখায় তিনি রক্ষা পেয়ে যান।
দুর্জন সিংহ
রাজা দুর্জন সিংহ নির্মিত মদনমোহন মন্দির।
১৬৯৪ সালে দুর্জন সিংহ মদনমোহন মন্দির নির্মাণ করেন। পারিবারিক নথি অনুযায়ী, বিষ্ণুপুরের রাজারা মুসলমান শাসকদের রাজস্ব প্রদান করলেও, অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তাঁরা স্বাধীনই ছিলেন। মুসলমান ঐতিহাসিকেরাও এই ব্যাপারে একই কথা লিখছেন। বিষ্ণুপুরের রাজারা করদ রাজা হলেও, মুর্শিদাবাদের দরবারে তাঁদের উপস্থিত থাকতে হত না। তবে মুর্শিদাবাদে তাঁদের একজন রাজপ্রতিনিধি থাকতেন।
মারাঠা আক্রমণ
সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে বিষ্ণুপুরের রাজারা ছিলেন সমৃদ্ধির শিখরে। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ থেকে এই রাজবংশের পতন শুরু হয়। প্রথমে বর্ধমানের মহারাজা ফতেহপুর মহল অধিকার করে নেন। এরপর মারাঠা আক্রমণকারীরা এই অঞ্চলে ব্যাপক লুটতরাজ চালায়।

গোপাল সিংহ
জোড় মন্দির চত্বর, বিষ্ণুপুর, ১৭২৬ খ্রিস্টাব্দ। রাজা গোপাল সিংহের আমলে নির্মিত পাথরের মন্দির।
গোপাল সিংহ (১৭৩০-১৭৪৫) ছিলেন ধার্মিক রাজা। কিন্তু রাজ্যে সমাগত বিপদের মোকাবিলা করার শক্তি তাঁর ছিল না। তিনি মল্লভূমের সকল প্রজাকে সন্ধ্যায় হরিনাম করার নির্দেশ জারি করেছিলেন। ১৭৪২ সালে ভাস্কর রাওয়ের নেতৃত্বে মারাঠারা বিষ্ণুপুর আক্রমণ করলে, তাঁর বাহিনী কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তোলে। গোপাল সিংহ সেনাবাহিনীকে দুর্গের মধ্যে প্রত্যাহার করে নেন ও দুর্গ সুরক্ষিত করেন। তিনি নগরবাসীকে মদনমোহনের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করতে বলেন। কথিত আছে, মদনমোহন সেই ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন। বিষ্ণুপুরের বিখ্যাত দলমাদল কামান মানুষের সহায়তা বিনাই নাকি গর্জে উঠেছিল। সম্ভবত মারাঠারা কঠিন দুর্গপ্রাকার ধ্বংস করতে না পেরে ফিরে গিয়েছিলেন। মারাঠারা এরপর রাজ্যের অপেক্ষাকৃত কম সুরক্ষিত অঞ্চলগুলিতে লুটতরাজ চালায়। ১৭৬০ সালে দ্বিতীয় শাহ আলমের যুদ্ধাভিযানের কালে মারাঠা সর্দার শেওভাট বিষ্ণুপুরকে সদর করেছিলেন। মারাঠারা বিষ্ণুপুর ও বীরভূমের সীমান্ত অঞ্চলে এমন ভয়াবহ লুণ্ঠন চালান যে, এই একদা-সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলি দারিদ্র্যের অন্ধকূপে বন্দী হয়ে পড়ে। অনেকেই রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে যান, এবং রাজ্য জনবিরল হয়ে পড়ে।

চৈতন্য সিংহ
চৈতন্য সিংহও ধার্মিক রাজা ছিলেন। কিন্তু তাঁকেও প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। তিনি ধর্মকর্ম নিয়ে এতই ব্যস্ত থাকতেন যে, প্রশাসনিক কাজকর্ম কিছুই দেখতেন না। এরই সুযোগ নিয়ে দামোদর সিংহ নামে তাঁর এক জ্ঞাতিভাই ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেন। তিনি মুর্শিদাবাদের দরবারে নিজের যোগ্যতা প্রমাণে সমর্থ হন। প্রথমে সিরাজদ্দৌলা তাঁকে নিজ বাহিনী ধার দেন। কিন্তু তিনি বিষ্ণুপুর দখলে অসমর্থ হন। ইংরেজদের হাতে সিরাজের পরাজয়ের পর মীর জাফর দামোদর সিংহকে আরও শক্তিশালী বাহিনী ধার দেন। এইবার তিনি বিষ্ণুপুর দখল করতে সমর্থ হন। চৈতন্য সিংহ মদন গোপালের বিগ্রহ নিয়ে কলকাতায় পালিয়ে আসেন। এরপর রাজ্যের মালিকানা নিয়ে বহুদিন মামলা মোকদ্দমা চলে। এই মামলা চালাতে গিয়ে বিষ্ণুপুর রাজ পরিবারের পতন সম্পূর্ণ হয়। শেষে ১৮০৬ সালে রাজস্ব বাকি রাখার দায়ে রাজ্য বিক্রি হয়ে যায় এবং বর্ধমানের রাজা সমগ্র এস্টেটটি কিনে নেন।
ব্রিটিশ প্রশাসনের সূচনাকাল
১৭৬০ সালে বর্ধমান চাকলার অবশিষ্টাংশের সঙ্গে বিষ্ণুপুরও ব্রিটিশ শাসনাধীনে আসে। মারাঠা অত্যাচারের পর ছিয়াত্তরের মন্বন্তর এখানকার অর্থনীতিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়। জনসংখ্যা হ্রাস পায়, শস্য উৎপাদন কমে যায় এবং আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে। অতীতের শক্তিশালী রাজ্য বিষ্ণুপুর কেবল এক জমিদারিতে রূপান্তরিত হয়। ১৭৮৭ সালে, বিষ্ণুপুর বীরভূমের অন্তর্ভুক্ত হয়। সিউড়িকে সদর করে এটি একটি পৃথক জেলার মর্যাদা লাভ করে। বিষ্ণুপুর অঞ্চলে বিদ্রোহের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এই বিদ্রোহ চুয়াড় বিদ্রোহ নামে পরিচিত। ১৭৯৩ সালে বাঁকুড়া পৃথক জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং বর্ধমান বিভাগের অন্তর্ভুক্ত হয়।
চুয়াড় বিদ্রোহ
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে বাঁকুড়া জেলার রায়পুরে চুয়াড় বিদ্রোহের সূত্রপাত ঘটে। এই বিদ্রোহের নেতা ছিলেন রায়পুরের পূর্বতন জমিদার দুর্জন সিংহ। প্রায় ১,৫০০ অনুগামী নিয়ে তিনি প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পুলিশ এই বিদ্রোহ দমনে ব্যর্থ হয়। এই সময় বাঁকুড়া জঙ্গল মহলের অন্তর্গত ছিল। চুয়াড় বিদ্রোহ চলাকালীনই বাঁকুড়া ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক উন্নতির পথে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সোনামুখীতে কোম্পানির কুঠি গড়ে ওঠে। এই কুঠির ৩১টি অধীনস্থ কুঠি ছিল, যার একটি পাত্রসায়র এবং অপর দুটি বীরভূমের সুরুল ও ইলামবাজারে গড়ে ওঠে। ১৮৩২ সালে চুয়াড় বিদ্রোহের ফলস্রুতিতে ১৮৩৩ সালে জঙ্গল মহল ভেঙে দেওয়া হয়। বিষ্ণুপুর বর্ধমানের সঙ্গে যুক্ত হয়। জেলার অধিকাংশ অংশ মানভূমের অঙ্গীভূত হয়। এই অঞ্চলটি সেই সময় নর্থ-ওয়েস্ট ফ্রন্টিয়ার এজেন্সি নামে পরিচিত ছিল। ১৮৭২ সালে, সোনামুখী, ইন্দাস, কোতুলপুর, শেরগড় ও সেনপাহাড়ি বর্ধমানের অন্তর্ভুক্ত হয়।


বর্তমান বাঁকুড়া
১৮৭৯ সালে, মানভূমের খাতড়া, রায়পুর ও সিমলাপাল আউটপোস্ট এবং বর্ধমানের সোনামুখী, কোতুলপুর ও ইন্দাস যুক্ত করে বাঁকুড়া জেলার বর্তমান আকারটি দেওয়া হয়। যদিও প্রথম দিকে এটি পশ্চিম বর্ধমান জেলা নামে পরিচিত ছিল। ১৮৮১ সালে এই জেলার নামকরণ হয় বাঁকুড়া জেলা।
তথ্যসুত্র ঃ গুগল
ফটো:-রীতা নন্দী, শ্রী মুখার্জি ও অনির্বান

পান্ডুয়া

 পান্ডুয়া। আদিতে এখানে হিন্দু পান্ডু রাজার গড় ছিল। প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে বাংলার সুলতানি যুগের পূর্বেও পান্ডুয়ার একটি ইতিহাস রয়েছে।

 ধোয়ী (খ্রিস্টীয় বারো শতক) তাঁর পবনদূত এ সুহ্ম অঞ্চলে (হুগলিতে গঙ্গা নদীর তীরবর্তী অঞ্চল) মুরারি, রঘুকুলগুরু এবং অর্ধনারীশ্বর মন্দিরসমূহের কথা উল্লেখ করেছেন। সাধারণভাবে বিশ্বাস করা হয় যে, এ মন্দিরগুলি ত্রিবেণী-সপ্তগ্রাম-পান্ডুয়ার অন্তর্গত ভূমিতে অবস্থিত ছিল। এ ধারণাকে আরও জোরদার করেছে পরবর্তীকালের মুসলিম স্থাপত্যশিল্পে পূর্ববর্তী যুগের ভেঙ্গে ফেলা বা ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরসমূহের মসলার পুনর্ব্যবহার।

স্থানীয় পান্ডব রাজার নামানুসারে স্থানটির নামকরণ করা হয়েছে বলে কিংবদন্তি রয়েছে। কিংবদন্তিতে এ পান্ডব রাজা কিভাবে ফিরুজ শাহর জনৈক আত্মীয় শাহ সফিউদ্দীনের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন এবং কিভাবে তাঁর রাজা তুর্কি-আফগান শাসনাধীনে এসেছিলেন তার বর্ণনা রয়েছে। পান্ডব রাজ্য সুলতানি রাজ্যাংশে পরিণত হওয়া সম্পর্কিত কিংবদন্তির কোনো নির্ভরযোগ্য সমর্থন পাওয়া যায় না। এ যুগের ঐতিহাসিক দলিলপত্র কিংবদন্তির শাহ শফি সম্পর্কে নিরব।বর্তমানে বরী মসজিদ খ্যাত পান্ডুয়ায় অবস্থিত প্রাক-মুগল যুগের একটি প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত চিত্তাকর্ষক মসজিদ। এটি সম্মুখভাগে ‘সাহান’ (উন্মুক্ত অঙ্গন) বিহীন ৭০.৪১ মি x ১২.৫ মিটার আয়তনের একটি আয়তাকার মসজিদ। দুটি সমান্তরাল ব্যাসল্ট পাথরের স্তম্ভের সারি (১.৮৩ মি উঁচু) মসজিদটির অভ্যন্তরকে তিনটি আইলে ভাগ করেছে। ফলে তেষট্টিটি ‘বে’র সৃষ্টি হয়েছে। খিলান ও ইটের পেন্ডেন্টিভের উপর প্রতিষ্ঠিত ৬৩টি গম্বুজের ছাদ বর্তমানে বিলুপ্ত। আইলের একই সরল রেখায় প্রতি সারিতে ২১ টি করে মোট তিনটি সারিতে গম্বুজগুলি বিন্যস্ত। ব্যাসল্ট স্তম্ভগুলি প্রাক-ইসলামি স্থাপত্য থেকে আনা হয়েছে এবং এগুলি ভিন্ন ভিন্ন ডিজাইনের। কয়েকটি স্তম্ভ হিন্দু ও বৌদ্ধ প্রতিমূর্তির চিহ্ন বহন করছে।

বরী মসজিদ
কিবলা দেয়ালে ২১টি মিহরাব রয়েছে, যার মধ্যে কেন্দ্রীয়টি সবচেয়ে বড় এবং সর্বাধিক অলংকৃত। প্রাক-মুগল যুগের দেশীয় রীতিতে একটি অলংকৃত খাঁজকাটা খিলান রয়েছে মিহরাবের কেন্দ্রে। খিলানের স্প্যান্ড্রিল-এ গোলাপের মেডেলিয়ন উৎকীর্ণ। মিহরাবের দেয়াল বিভিন্ন মোটিফ দ্বারা নকশা করা। কেন্দ্রীয় মিহরাবের ডানপাশে কালো ব্যাসল্ট পাথরের সিংহাসন আকৃতির মিম্বারে তিনখাঁজবিশিষ্ট খিলানের ক্যানপি বা চাঁদোয়া রয়েছে, যার ভেতরে রয়েছে পূর্ণ প্রস্ফুটিত পদ্ম। এছাড়াও শিকলঘণ্টা, ‘মকর’ (কুমির ও মাছের সমন্বয়ে কল্পিত একটি পৌরাণিক প্রাণী), কীর্তিমুখ (সিংহের আবক্ষ মূর্তি) এবং আরও কিছু মোটিফ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ থেকে সংগৃহীত প্রস্তরখন্ডে লক্ষ করা যায়। ব্যাসল্ট পাথরের স্তম্ভের গায়ে বিভিন্ন প্যাটার্নের সমান্তরাল ব্যান্ড রয়েছে।
মসজিদটিতে ২১ টি খিলানযুক্ত প্রবেশপথ রয়েছে। পার্শ্ব হতে আইলে প্রবেশের পথ তৈরির জন্য ইমারতের উত্তর ও দক্ষিণ পাশে তিনটি করে প্রবেশপথ রয়েছে। এখন একটি ব্যাতিরেকে অন্য সকল পার্শ্ব প্রবেশপথই বন্ধ। ফলে, মসজিদটিতে বর্তমানে ২২টি প্রবেশপথ রয়েছে। এ থেকেই মূলত এর স্থানীয় নাম হয়েছে ‘বাইশ দরওয়াজা’।
কোন শিলালিপির অনুপস্থিতির কারণে এ মসজিদের নির্মাতা বা নির্মাণকাল সম্বন্ধে সঠিক সিদ্ধান্ত করা যায় না। শাহ সাইফুদ্দীনের সঙ্গে এ মসজিদের সম্পর্ক আছে বলে স্থানীয়ভাবে মনে করা হয়। বলা হয়ে থাকে যে, ফিরুজ শাহ (শামসুদ্দীন ফিরুজ শাহ নামে পরিচিত)-এর আদেশে জাফর খান গাজীর সঙ্গে শাহ সাইফুদ্দীন পান্ডুয়া আক্রমণ ও জয় করেছিলেন। এ কাল্পনিক ঘটনার কোন নির্ভরযোগ্য প্রমাণ এ পর্যন্ত পাওয়া যায় নি। কিছু স্থাপত্য উপাদান যেমন, লাল সরু ইটের ব্যবহার, ছাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়া নিচু অবতল আকৃতির গম্বুজ, লিওয়ানে সাধারণ পাথরের স্তম্ভ, ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরের উপাদানের ব্যবহার, নিচু খিলানযুক্ত প্রবেশপথ ইত্যাদি থেকে মসজিদটির নির্মাণকাল চৌদ্দ শতকের বলে মনে করা হয়। ছাদ বহুকাল আগেই ধ্বসে পড়ে গেছে, পাথরের থামগুলি দাঁড়িয়ে আছে, দেওয়াল জুড়ে সুক্ষ্ণ পোড়ামাটির কাজ। পাশেই সুউচ্চ মিনার (৩৮.১০ মিটার)। এটিও প্রাচীন, সম্ভবত বিজয়স্তম্ভ হিসেবে নির্মিত। মিনারের প্রবেশের মুখে (বন্ধ) হিন্দু দেবমূর্তির আদলে কিছু প্রস্তর বসানো আছে।বরী মসজিদের সন্নিকটে শাহ সফিউদ্দীনের আস্তানা অবস্থিত। এর মধ্যে অন্যান্য দালান ছাড়াও রয়েছে মুগলরীতিতে নির্মিত এক গম্বুজবিশিষ্ট শাহ শফির সমাধি ভবন এবং কারিয়া মসজিদ। এ দুটি বহু সংস্কারকৃত দালানের মধ্যে শেষোক্তটি একটি পাতলা লাল ইটের ভবন। এটি এক সময় আরব্য নকশা এবং জ্যামিতিক নকশায় সুসজ্জিত ছিল। এ আস্তানায় ঘষে মুছে ফেলা একটি প্রস্তর মূর্তির পেছনে উৎর্কীণ শিলালিপিতে ১৪৭৭ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মাহমুদ শাহ-এর পৌত্র এবং সুলতান বারবক শাহের পুত্র সুলতান ইউসুফ শাহের রাজত্বকালে একটি মসজিদ নির্মাণের বিষয় উল্লেখ রয়েছে। লেখাটি সম্ভবত কারিয়া মসজিদ সম্পর্কে। ১৭৬৩-৬৪ খ্রিস্টাব্দে জনৈক লাল কুনোয়ার নাথ ধবংসপ্রাপ্ত মসজিদটি মেরামত করেছিলেন।

আঠারো-উনিশ শতকে সস্তা কিন্তু মানসম্মত কাগজের উৎপাদন-কেন্দ্র হিসেবে পান্ডুয়া খ্যাতি অর্জন করে। ঊনিশ শতকের মধ্যভাগে ইউরোপ হতে যন্ত্রনির্মিত কাগজ আমদানি শুরু হলে শিল্পটির পতন ঘটে। পান্ডুয়া বর্তমানে চাল ব্যবসায়ের একটি গুরুত্বপুর্ণ কেন্দ্র।
তথ্যসুত্র ঃ- গুগল, ছবি- নিজ,সুস্মিত মজুমদার,উমাপ্রসাদ নাগ 

Friday, 4 November 2016

শ্রীপুর বলাগড়ের রাসমেলা ও বিন্দুবাসিনী পুজো হোক বলিবিহীন,নির্মল,.............মা বিন্দুবাসিনীর চরণে নিরীহ পশুদের বদলে ,আমরা বলি দিই আমাদের কাম ,ক্রোধ,লোভ ও হিংসাকে ,...........


"যখন দেবীর সম্মুখে বলির সকর্দম রক্ত সর্বাঙ্গে মাখিয়া সকলে উত্কট চিত্কারে ভীষণ উল্লাসে প্রাঙ্গণে  নৃত্য করিতে থাকে তখন কি তাহারা মায়ের পূজা করে, না নিজেদের হৃদয়ের মধ্যে যে হিংসারাক্ষাসী আছে সেই  রাক্ষসীটারই পূজা করে "                                                                    --------রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 

 

    ধর্মের নাম নরবলি আগে হত।কিন্তু নরবলি বে-আইনি ঘোষিত হওয়ার পর, বিশেষত নরবলি দিলে অপরাধীর ফাঁসি পর্যন্ত হতে পারে এই বার্তা পৌছে যাওয়ার পর নরবলি  বন্ধ হয়ে গেছে। যে কোনো ধরনের পাশুবলিই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বলি এক অমানবিক নিষ্ঠুর প্রথা। নরবলি থেকে পশুবলি  সব ক্ষেত্রেই অপরকে মেরে নিজেকে সুখী করার প্রবনতা, যা সমাজবাদ্ধ মানবপ্রজাতির অগ্রগতির বিরোধী। এরই  সঙ্গে চলে বলির সংখ্যা বাড়িয়ে পাল্লা দেওয়ার রেষারেষির প্রবনতা। 
ফটো :-রীতা নন্দী সৌজন্যে

হুগলী জেলার বলাগড় থানার শ্রীপুর গ্রামের রাস উৎসব হিন্দু ধর্মের শাক্ত,শৈব  ও বৈষ্ণব ধারার মিলনক্ষত্র। আজ থেকে প্রায় ৩৫০ বছর আগে রঘুনন্দন মিত্রমুস্তাফী নদীয়া জেলার উলা-বীরনগর থেকে এসে শ্রীপুরে জমিদারির পত্তন করেন। তিনি একটি গড়বিশিষ্ট  এলাকায় প্রাসাদ,মন্দিররাজি,চণ্ডীমণ্ডপ ইত্যাদি গড়ে তোলেন।

 রঘুনন্দন ছিলেন বৈষ্ণব, গড়ের চত্বরের মধ্যেজোড়াশিল্পের পঞ্চরত্ন মন্দির আছে,শিখরগুলি রেখ ধরণের খাঁজকাটা,আর সামনের ভাগের মাটির ফলকের ওপর উদ্ভিদধর্মী কারুকাজ।এ ছাড়া ওই গড় এলাকার মধ্যেই একটি আটচালা শিবমন্দির,দোলমঞ্চ ও রাধাগোবিন্দ মন্দির আছে। গড় এলাকার বাইরে রাস্তার ওপর একটি আটচালা শিবমন্দির,বিন্ধ্যাবাসিনী দেবীর পুজোরর দালান এবং একটি খিলানস্তম্ভে তৈরী রাসমঞ্চ আছে। 
চণ্ডীমণ্ডপটির নির্মাণ সময় ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দ। পঞ্চরত্ন মন্দিরটি ও অন্যান্য মন্দিরগুলি ঊনবিংশ শতকে নির্মিত। শ্রীপুরের গোবিন্দ মন্দিরটি একচূড়া বিশিষ্ট,১৭৯৭  খ্রিস্টাব্দে নিধিরাম মুস্তাফি এটি নির্মাণ করেন। আর মন্দিরের সামনের দোলমঞ্চটি ১৭৪৬ খ্রিস্টাব্দে রুদ্ররাম মুস্তাফি নির্মাণ করিয়েছিলেন। 

 রাস পূর্ণিমায় শ্রীপুর গ্রামে সপ্তাহব্যাপী চলে রাসমেলা ,বস্তুত এটাই গ্রামের মূল অনুষ্ঠান। আগেই বলছি এই মেলা শাক্ত বৈষ্ণব ও শৈব ধারার এক মিলনমেলা।  একাধারে রাধাকৃষ্ণের রাস ,বিন্দুবাসিনী দেবীর পূজা ও বিন্দুবাসিনী দেবীর সাথে মহাদেবের বিবাহানুষ্ঠান এই সব মিলে মেলা জমজমাট। 

 এই উপলক্ষ্যে সারাদিন ধরে চলে যাত্রানুষ্ঠান,নাটক,আতশবাজির প্রদর্শনী আরও অনেক অনুষ্ঠান। 

এত সুন্দর জমজমাট অনুষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে একটি নৃশংস অধ্যায়, পশুবলি। দীর্ঘদিন ধরে এখানে ভেড়া ছাগল ও মোষবলির মত নৃশংস প্রথা চালু রয়েছে। আমার ধারণা সব ধর্মেই ধর্মের মোড়কে নৃশংসতা সৃষ্টি হয়েছিল একটা সাধু উদ্দেশ্য নিয়ে,(অবশ্য এটা আমার নিজস্ব ব্যাখ্যা,আমি পন্ডিত নই ,ধর্ম সম্পর্কে বিশেষ কিছু বুঝিও না , আমি আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে যতটুকু বুঝি,তাই বলার চেষ্টা করি ) একসময় বিরাট সংখক মানুষ আর্থিকভাবে অনুন্যত ছিল,রাজা বা ধনী মানুষের পৃষ্ঠপোষকতায় পশুদের বলি বা কুরবানী করে তার মাংস এই দরিদ্র শ্রেণীর বিতরণ করা হতো। শ্রীপুরে জমিদার রঘুনন্দনের ব্যাবস্থাপনায় তাঁর দরিদ্র প্রজাদের জন্য ভেড়া ও ছাগলবলি ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রজাদের জন্য মোষ বলি প্রথা চালু করা হয়েছিল।  রঘুনন্দন মিত্রমুস্তাফির সময় থেকে আমরা ৩০০ বছরের বেশি সময় পেরিয়ে এসেছি , বর্তমান সামাজিক পরিস্থিতিতে এত সুন্দর একটা অনুষ্ঠানে মোষ বলি বা পশুবলির মতো পৈশাচিক,মানবতা বিরোধী একটা প্রথা চালু রাখার কোনো যুক্তি আমি খুঁজে পাইনা। 

অনেকের ধারনা আছে ধর্মীয়  কারনে বলি দিলে মানসিক শক্তির বিকাশ হয়। অথচ পুজোর নাম নৃশংস এই প্রথা কোন ভাবেই মানসিক শক্তি বৃদ্ধি করে না। দুর্বল ও অবলা প্রানীদের যে  নৃশংসতার সঙ্গে হত্যা করা  হয় তাতে 'খুনি' মানসিকতার জন্ম হয়।মনোবিজ্ঞানীদের এবং মনোরোগ চিকিৎসকদের মতে বলির ভয়ানক দৃশ্য শিশুমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলে। এর থেকে নানারকম মানসিক রোগ, ভীতি নিদ্রাহীনতা হাতে পারে।

মানুষের একমাত্র ধর্ম হলো মানবধর্ম, আর মানবধর্মের মূলকথাই হলো মানবতা(Humanity )।  
ধর্মের নাম করে এই নৃশংসতা ,যা মানুষকে পীড়া দেয়, দৃশ্য দুষণ ঘটায় ও শিশুমনে  বিকৃতির  জন্ম দেয় , এমন কাজ কখনোই  'ধর্ম 'হতে পারে না। পাবলিক নুইসেন্স এক্ট (Public Nuisance Act) বা সংবিধানের ২৬ নং ধারা অনুযায়ী সব মানুষের দাবি হওয়া উচিত এই প্রথ বন্ধ করা। 

    অনেকের মানে প্রশ্ন জগতে পারে আমরা কি তাহলে মাংস খাবোনা ? বলি সংক্রান্ত আগের আমার একটি পোস্ট এ আমি বলেছিলাম পরিবেশের  ইকোসিস্টেম অনুযায়ী  পৃথিবীর নিয়মই হচ্ছে খাদ্য খাদকের ,তৃণভোজী মাংসাশী কেউই এই নিয়মের বাইরে নয় . এইক্ষেত্রে বলে রাখি একটি গাছ ও কিন্তু একটি প্রাণ . জীবনধারণের জন্য খাদ্য খাদকের সম্পর্ক আর ধর্মের নাম করে নৃসংশ প্রাণীহত্যা ,....... এই দুটোর প্রেক্ষিত আলাদা . যে কোনো ধর্মেরই মূল কথা হলো ,মানবতা,ত্যাগ,উদারতা ,সমবেদনা ,ইত্যাদি . এই নৃশংসতা কোনো ধর্মানুরাগ হতে পারে না ..........
ইকো-সিস্টেম অনুযায়ী , খাদ্য-খাদক সম্পর্কের ভিত্তিতে অবশ্যই আমরা মাংস খেতে পারি। আমরা  মাংসের দোকান থেকে মাংস কিনে খাই আমাদের শরীরের চাহিদা মেটাবার জন্য। 
 বলি শব্দের প্রকৃত অর্থ পূজা-উপহার। এ ছাড়া প্রামান্য অভিধানে এর অর্থ আছে কর, উপহার ইত্যাদি। পশুবধ কথাটি পরবর্তীকালে এসেছে। 'বলি' শব্দের উত্পত্তি বল-ধাতু থেকে। অর্থ- জীবন, বেষ্টন, সমৃদ্ধি, দান। এ ছাড়া বল-ধাতুর যে হিংসা ও বধ অর্থ আছে, তার মানেও জীবন ও বৃদ্ধিতে যা' হানি আনে তাকে হিংসা করা, তাকে বধ করা।কিন্তু আমরা মানুষ, তাঁর সৃষ্ট শ্রেষ্ঠ জীব হয়েও প্রবৃত্তির তাড়নায় অনেকেই তাঁরই সৃষ্ট দুর্বল জীবকে হত্যা করে নিজের রসনাকে পরিতৃপ্ত করতে চাই। জগন্মাতার চরণে তাঁর সন্তানকেই বলি দিয়ে তাঁর পূজা করতে চাই। মা কি নিজ সন্তানের রক্ত পান করে পরিতৃপ্ত হন ? না, আমাদের রসনার পরিতৃপ্তির জন্যই এই বলিদান প্রথা ?যদি তাই হয় যাঁদের জন্য শ্রীপুরের এই মোষ বলিদান প্রথা শুরু হয়েছিল (রঘুনন্দন মিত্রমুস্তাফির জমিদারীর অনার্য ও আদিবাসী প্রজা ) তাঁরা তো কেউই আর মোষের মাংস খান না , তাহলে এই মোষ বলির যুক্তি কোথায় ?
  ধর্মীয় অনুষ্টানে ঈশ্বরের সামনে বলি দেওয়া উচিৎ আমাদের কাম,ক্রোধ,লোভ ইত্যাদি পাশবিক প্রবৃত্তিগুলোকে, কিন্তু তার বদলে নিরীহ পশুদের হত্যা করি যা অমানবিক, নিষ্ঠুর  এবং অবৈজ্ঞানিক চিন্তা  করার ফসল। 
অনেকের বিশ্বাস ঈশ্বর এর কাছে পশুবলি দিলে আমার ভালোও হবে বা মঙ্গল হবে , তাঁদের উদ্দেশ্যে বলি,নিজের বা পরিবারের ভালোর জন্য অন্য কাউকে বিপদে ঠেলে ফেলে দেওয়া, প্রয়োজনে মেরে ফেলা এই চিন্তা অমানবিক ,যা নরবলি থেকে পশুবলী সবক্ষেত্রেই  প্রযোজ্য।   সমাজবদ্ধ মানব প্রজাতির অগ্রগতির  বিরোধী।
 বেশ কয়েক বছর ধরে শ্ৰীমতী রীতা নন্দী ,শ্রী অনুপ প্রামানিক,শ্রী সৈকত রায় ও আরও বলাগড়ের কিছু কুসংস্কারমুক্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ রাসমেলায় পশুবলি বন্ধের পক্ষে গ্রামবাসীদের মধ্যে সামাজিক সচেতনতা আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।  
         নিঃসান্দেহে তাঁদের  এই সামাজিক আন্দোলন (ধার্মিয় অনুষ্ঠানে পাশুবলির বিরুদ্ধে আন্দোলন)সামাজিক সচেতনতা ও প্রশংসার দাবী রাখে। আসুন আমরা , আপনারা সবাই  এই আন্দোলনের শরিক হই,বন্ধহোক এই নৃশংস প্রথা পশুবলি ।
যাঁরা  রাসমেলায় পশুবলির পক্ষ্যে ৩০০ বছরের পরম্পরার যুক্তি দেখাচ্ছেন ,তাঁদের উদ্দেশ্যে বলি ,৩০০ বছর আগে বেশিরভাগ মানুষ পাতার কুটিরে বসবাস করত ,হেটে বা ঘোড়ায় চেপে  যাতায়াত করত ,বাচ্ছাদের লেখাপড়া শেখানোর (বিশেষ করে মেয়েদের )প্রচলন ছিল না, টোল বা গুরুগৃহে পঠনপাঠন চলতো, আইন ও শাসনের ক্ষেত্রে রাজা বা জমিদারী ব্যাবস্থাই শেষ কথা ছিল ,ইত্যাদি ইত্যাদি,.........
তবে কি আগামী দিনে আমরা দেখতে পাব পরম্পরা মেনে শ্রীপুর গ্রামে লাইব্রেরি,স্কুল ,ইলেক্ট্রিসিটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, পাকা রাস্তা ভেঙে কাঁচা করে দেওয়া হয়েছে, বাচ্ছাদের স্কুল\কলেজ ছাড়িয়ে গ্রামের টোল এ ভর্তি করা হয়েছে, গ্রামের জমিদারী প্রথা ফিরিয়ে আনা  হয়েছে,জমিদারবাবুর পৃষ্ঠপোষকতায় বিন্দুবাসিনী পুজোয় প্রচুর পশুবলি হচ্ছে এবং মোষ সহ সেইসব প্রসাদী মাংস সবাই কবজি ডুবিয়ে খেতে খেতে জমিয়দারবাবুর জয়ধ্বনি করছে,................ সারা পৃথিবী থেকে দলে দলে পর্যটক আসছে শ্রীপুর গ্রামে ৩০০ বছর আগের ভারতবৰ্ষের সামাজিক অবস্থাকে দেখতে,..............
        আর তা যদি না হয় , তবে সমাজ ও সময়কে সম্মান জানিয়ে মোষ বলির মতো মধ্যযুগীয় প্রথার প্রতিবাদ জানান। 
      প্রসাদ বিতরণ ই যদি  বলিদান প্রথার উদ্দেশ্য হয় তবে জ্যান্ত মোষ বা অন্যান্য পশুর বদলে আমরা সন্দেশ,ক্ষীর বা অন্যান্য পশুর প্রতিকৃতি বানিয়ে বিন্দুবাসিনীর সামনে বলি দেওয়া যেতেই  পারে। 
     আর বিন্দুবাসিনী দেবীকে যদি রক্ত নিবেদন করতে হয়,  নিরীহ পশুবলির বদলে আয়োজন করা যেতে পারে রক্তদান শিবিরের , এতে ধর্মাচরণ ও সমাজ-সচেতনতা দুইই সম্ভব।


      আজ না হয় কাল পশুবলির মত নৃশংস প্রথা বন্ধ হবেই , আজ যাঁরা পশুবলির পক্ষে রয়েছেন,তাঁরা নিজেদের এবং সন্তান,সন্ততিদের কাছে লজ্জিত হবেন,..........

                " যে পূজার বেদী রক্তে গিয়েছে ভেসে 
                  ভাঙো ভাঙো আজি ভাঙো তারে নিঃশেষে
            
                  ধর্মকারার প্রাচীরে বজ্র হানো ,
                  এ অভাগা দেশে জ্ঞানের আলোক আনো। "
                                          --------রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 
তথ্য সহায়তা :- অধ্যাপক পার্থ চট্টোপাধ্যায়, শ্রী অসীম রায় 
ফটো :- রীতা নন্দী