পান্ডুয়া। আদিতে এখানে হিন্দু পান্ডু রাজার গড় ছিল। প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে বাংলার সুলতানি যুগের পূর্বেও পান্ডুয়ার একটি ইতিহাস রয়েছে।
ধোয়ী (খ্রিস্টীয় বারো শতক) তাঁর পবনদূত এ সুহ্ম অঞ্চলে (হুগলিতে গঙ্গা নদীর তীরবর্তী অঞ্চল) মুরারি, রঘুকুলগুরু এবং অর্ধনারীশ্বর মন্দিরসমূহের কথা উল্লেখ করেছেন। সাধারণভাবে বিশ্বাস করা হয় যে, এ মন্দিরগুলি ত্রিবেণী-সপ্তগ্রাম-পান্ডুয়ার অন্তর্গত ভূমিতে অবস্থিত ছিল। এ ধারণাকে আরও জোরদার করেছে পরবর্তীকালের মুসলিম স্থাপত্যশিল্পে পূর্ববর্তী যুগের ভেঙ্গে ফেলা বা ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরসমূহের মসলার পুনর্ব্যবহার।
স্থানীয় পান্ডব রাজার নামানুসারে স্থানটির নামকরণ করা হয়েছে বলে কিংবদন্তি রয়েছে। কিংবদন্তিতে এ পান্ডব রাজা কিভাবে ফিরুজ শাহর জনৈক আত্মীয় শাহ সফিউদ্দীনের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন এবং কিভাবে তাঁর রাজা তুর্কি-আফগান শাসনাধীনে এসেছিলেন তার বর্ণনা রয়েছে। পান্ডব রাজ্য সুলতানি রাজ্যাংশে পরিণত হওয়া সম্পর্কিত কিংবদন্তির কোনো নির্ভরযোগ্য সমর্থন পাওয়া যায় না। এ যুগের ঐতিহাসিক দলিলপত্র কিংবদন্তির শাহ শফি সম্পর্কে নিরব।বর্তমানে বরী মসজিদ খ্যাত পান্ডুয়ায় অবস্থিত প্রাক-মুগল যুগের একটি প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত চিত্তাকর্ষক মসজিদ। এটি সম্মুখভাগে ‘সাহান’ (উন্মুক্ত অঙ্গন) বিহীন ৭০.৪১ মি x ১২.৫ মিটার আয়তনের একটি আয়তাকার মসজিদ। দুটি সমান্তরাল ব্যাসল্ট পাথরের স্তম্ভের সারি (১.৮৩ মি উঁচু) মসজিদটির অভ্যন্তরকে তিনটি আইলে ভাগ করেছে। ফলে তেষট্টিটি ‘বে’র সৃষ্টি হয়েছে। খিলান ও ইটের পেন্ডেন্টিভের উপর প্রতিষ্ঠিত ৬৩টি গম্বুজের ছাদ বর্তমানে বিলুপ্ত। আইলের একই সরল রেখায় প্রতি সারিতে ২১ টি করে মোট তিনটি সারিতে গম্বুজগুলি বিন্যস্ত। ব্যাসল্ট স্তম্ভগুলি প্রাক-ইসলামি স্থাপত্য থেকে আনা হয়েছে এবং এগুলি ভিন্ন ভিন্ন ডিজাইনের। কয়েকটি স্তম্ভ হিন্দু ও বৌদ্ধ প্রতিমূর্তির চিহ্ন বহন করছে।
বরী মসজিদ
কিবলা দেয়ালে ২১টি মিহরাব রয়েছে, যার মধ্যে কেন্দ্রীয়টি সবচেয়ে বড় এবং সর্বাধিক অলংকৃত। প্রাক-মুগল যুগের দেশীয় রীতিতে একটি অলংকৃত খাঁজকাটা খিলান রয়েছে মিহরাবের কেন্দ্রে। খিলানের স্প্যান্ড্রিল-এ গোলাপের মেডেলিয়ন উৎকীর্ণ। মিহরাবের দেয়াল বিভিন্ন মোটিফ দ্বারা নকশা করা। কেন্দ্রীয় মিহরাবের ডানপাশে কালো ব্যাসল্ট পাথরের সিংহাসন আকৃতির মিম্বারে তিনখাঁজবিশিষ্ট খিলানের ক্যানপি বা চাঁদোয়া রয়েছে, যার ভেতরে রয়েছে পূর্ণ প্রস্ফুটিত পদ্ম। এছাড়াও শিকলঘণ্টা, ‘মকর’ (কুমির ও মাছের সমন্বয়ে কল্পিত একটি পৌরাণিক প্রাণী), কীর্তিমুখ (সিংহের আবক্ষ মূর্তি) এবং আরও কিছু মোটিফ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ থেকে সংগৃহীত প্রস্তরখন্ডে লক্ষ করা যায়। ব্যাসল্ট পাথরের স্তম্ভের গায়ে বিভিন্ন প্যাটার্নের সমান্তরাল ব্যান্ড রয়েছে।
কিবলা দেয়ালে ২১টি মিহরাব রয়েছে, যার মধ্যে কেন্দ্রীয়টি সবচেয়ে বড় এবং সর্বাধিক অলংকৃত। প্রাক-মুগল যুগের দেশীয় রীতিতে একটি অলংকৃত খাঁজকাটা খিলান রয়েছে মিহরাবের কেন্দ্রে। খিলানের স্প্যান্ড্রিল-এ গোলাপের মেডেলিয়ন উৎকীর্ণ। মিহরাবের দেয়াল বিভিন্ন মোটিফ দ্বারা নকশা করা। কেন্দ্রীয় মিহরাবের ডানপাশে কালো ব্যাসল্ট পাথরের সিংহাসন আকৃতির মিম্বারে তিনখাঁজবিশিষ্ট খিলানের ক্যানপি বা চাঁদোয়া রয়েছে, যার ভেতরে রয়েছে পূর্ণ প্রস্ফুটিত পদ্ম। এছাড়াও শিকলঘণ্টা, ‘মকর’ (কুমির ও মাছের সমন্বয়ে কল্পিত একটি পৌরাণিক প্রাণী), কীর্তিমুখ (সিংহের আবক্ষ মূর্তি) এবং আরও কিছু মোটিফ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ থেকে সংগৃহীত প্রস্তরখন্ডে লক্ষ করা যায়। ব্যাসল্ট পাথরের স্তম্ভের গায়ে বিভিন্ন প্যাটার্নের সমান্তরাল ব্যান্ড রয়েছে।
মসজিদটিতে ২১ টি খিলানযুক্ত প্রবেশপথ রয়েছে। পার্শ্ব হতে আইলে প্রবেশের পথ তৈরির জন্য ইমারতের উত্তর ও দক্ষিণ পাশে তিনটি করে প্রবেশপথ রয়েছে। এখন একটি ব্যাতিরেকে অন্য সকল পার্শ্ব প্রবেশপথই বন্ধ। ফলে, মসজিদটিতে বর্তমানে ২২টি প্রবেশপথ রয়েছে। এ থেকেই মূলত এর স্থানীয় নাম হয়েছে ‘বাইশ দরওয়াজা’।
কোন শিলালিপির অনুপস্থিতির কারণে এ মসজিদের নির্মাতা বা নির্মাণকাল সম্বন্ধে সঠিক সিদ্ধান্ত করা যায় না। শাহ সাইফুদ্দীনের সঙ্গে এ মসজিদের সম্পর্ক আছে বলে স্থানীয়ভাবে মনে করা হয়। বলা হয়ে থাকে যে, ফিরুজ শাহ (শামসুদ্দীন ফিরুজ শাহ নামে পরিচিত)-এর আদেশে জাফর খান গাজীর সঙ্গে শাহ সাইফুদ্দীন পান্ডুয়া আক্রমণ ও জয় করেছিলেন। এ কাল্পনিক ঘটনার কোন নির্ভরযোগ্য প্রমাণ এ পর্যন্ত পাওয়া যায় নি। কিছু স্থাপত্য উপাদান যেমন, লাল সরু ইটের ব্যবহার, ছাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়া নিচু অবতল আকৃতির গম্বুজ, লিওয়ানে সাধারণ পাথরের স্তম্ভ, ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরের উপাদানের ব্যবহার, নিচু খিলানযুক্ত প্রবেশপথ ইত্যাদি থেকে মসজিদটির নির্মাণকাল চৌদ্দ শতকের বলে মনে করা হয়। ছাদ বহুকাল আগেই ধ্বসে পড়ে গেছে, পাথরের থামগুলি দাঁড়িয়ে আছে, দেওয়াল জুড়ে সুক্ষ্ণ পোড়ামাটির কাজ। পাশেই সুউচ্চ মিনার (৩৮.১০ মিটার)। এটিও প্রাচীন, সম্ভবত বিজয়স্তম্ভ হিসেবে নির্মিত। মিনারের প্রবেশের মুখে (বন্ধ) হিন্দু দেবমূর্তির আদলে কিছু প্রস্তর বসানো আছে।বরী মসজিদের সন্নিকটে শাহ সফিউদ্দীনের আস্তানা অবস্থিত। এর মধ্যে অন্যান্য দালান ছাড়াও রয়েছে মুগলরীতিতে নির্মিত এক গম্বুজবিশিষ্ট শাহ শফির সমাধি ভবন এবং কারিয়া মসজিদ। এ দুটি বহু সংস্কারকৃত দালানের মধ্যে শেষোক্তটি একটি পাতলা লাল ইটের ভবন। এটি এক সময় আরব্য নকশা এবং জ্যামিতিক নকশায় সুসজ্জিত ছিল। এ আস্তানায় ঘষে মুছে ফেলা একটি প্রস্তর মূর্তির পেছনে উৎর্কীণ শিলালিপিতে ১৪৭৭ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মাহমুদ শাহ-এর পৌত্র এবং সুলতান বারবক শাহের পুত্র সুলতান ইউসুফ শাহের রাজত্বকালে একটি মসজিদ নির্মাণের বিষয় উল্লেখ রয়েছে। লেখাটি সম্ভবত কারিয়া মসজিদ সম্পর্কে। ১৭৬৩-৬৪ খ্রিস্টাব্দে জনৈক লাল কুনোয়ার নাথ ধবংসপ্রাপ্ত মসজিদটি মেরামত করেছিলেন।
আঠারো-উনিশ শতকে সস্তা কিন্তু মানসম্মত কাগজের উৎপাদন-কেন্দ্র হিসেবে পান্ডুয়া খ্যাতি অর্জন করে। ঊনিশ শতকের মধ্যভাগে ইউরোপ হতে যন্ত্রনির্মিত কাগজ আমদানি শুরু হলে শিল্পটির পতন ঘটে। পান্ডুয়া বর্তমানে চাল ব্যবসায়ের একটি গুরুত্বপুর্ণ কেন্দ্র।
তথ্যসুত্র ঃ- গুগল, ছবি- নিজ,সুস্মিত মজুমদার,উমাপ্রসাদ নাগ
No comments:
Post a Comment