"খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো
বর্গি এল দেশে ,
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দেব কিসে? "
আজ থেকে প্রায় তিনশো বছর আগের কথা।১৭৪০ সাল।সরফরাজ খাঁকে হত্যা করে আলিবর্দি খাঁ বাংলার নবাব হয়েছেন।সরফরাজের শ্যালক রুস্তম জঙ্গ ছিলেন ওড়িশার নায়েব নাজিম।তিনি ভগ্নিপতি হত্যার প্রতিশোধ নিতে আলিবর্দিকে আক্রমণ করলেন। কিন্তু বালেশ্বরের কাছে এক যুদ্ধে রুস্তম আলিবর্দির কাছে পরাজিত হন।ওড়িশার মসনদে বসলেন আলিবর্দির ভাগ্নে। বিজয়ী আলিবর্দি খুশিমনে রওনা দিলেন মুর্শিদাবাদে নিজের রাজধানীতে।এদিকে রুস্তম জঙ্গও নিজের রাজত্ব ফিরে পেতে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করলেন। এবার আর একা নন , নাগপুরের মারাঠা শাসক রঘুজী ভোঁসলের সাহায্য চাইলেন রুস্তম। মারাঠা শক্তির সহায়তায় রুস্তম পুনরায় ওড়িশার নায়েব নাজিম হলেন বটে , কিন্তু বাংলা ,বিহার ওড়িশার আকাশে বয়ে নিয়ে এলেন দুর্যোগের কালো মেঘ , বর্গিহানা....................... মারাঠারা বুঝে নিল সুজলা, সুফলা, শস্যশ্যামলা বাংলার বুকে রয়েছে অশেষ সম্পদ।তা লুটে নেওয়াও খুব সহজ। এর পর থেকেই নিয়মিত মারাঠা বর্গির হানা শুরু হল বাংলায়।ভাস্কর পন্ডিতের নেতৃত্বে হুগলি জেলায় চুঁচুঁড়া, সপ্তগ্রাম, আরামবাগ, পান্ডুয়া ইত্যাদি অঞ্চল তছনছ করে দিয়েছিল বর্গিরা। তবে কয়েকটি অঞ্চলে বর্গিরা হারও মেনেছিল। যেমন বাঁশবেড়িয়ায়।আর একটি বাধা বর্গিরা টপকাতে পারেনি, সেটি হল গঙ্গা। পাঞ্চেত দিয়ে ঢুকে তারা যাবতীয় অত্যাচার চালাত গঙ্গার এপারেই। ১৭৫১ সাল পর্যন্ত বর্গিদের এই অত্যাচার চলে। শেষ পর্যন্ত বাংলার নবাব ও মারাঠাদের মধ্যে চুক্তি সম্পাদন হওয়ার পর শান্তি ফিরে আসে বাংলায়।
অষ্টাদশ শতাব্দীর লুটতরাজপ্রিয় অশ্বারোহী মারাঠা সৈন্যদলের নাম ‘বর্গি’। বাংলার নানান স্থানে প্রতি বছর প্রায় নিয়মকরেই একটা নির্দিষ্ট সময় (১৭৪১ – ১৭৫১) পর্যন্ত মারাঠাদের কিছু সংঘবদ্ধ লুটেরা এদেশে এসে লুটপাট করতো, সৃষ্টি করতো বিশৃঙ্খলার। লুট করে নিতো খেতের ফসল। ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দিতো, হত্যা করতো নিরীহ মানুষ। এইসব লুটেরাদেরকেই বাংলার মানুষজন বর্গী বলে ডাকতো। বর্গিহানা এই সময় একপ্রকার বাৎসরিক ঘটনায় পরিণত হয়েছিল।
অষ্টাদশ শতাব্দীর লুটতরাজপ্রিয় অশ্বারোহী মারাঠা সৈন্যদলের নাম ‘বর্গি’। বাংলার নানান স্থানে প্রতি বছর প্রায় নিয়মকরেই একটা নির্দিষ্ট সময় (১৭৪১ – ১৭৫১) পর্যন্ত মারাঠাদের কিছু সংঘবদ্ধ লুটেরা এদেশে এসে লুটপাট করতো, সৃষ্টি করতো বিশৃঙ্খলার। লুট করে নিতো খেতের ফসল। ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দিতো, হত্যা করতো নিরীহ মানুষ। এইসব লুটেরাদেরকেই বাংলার মানুষজন বর্গী বলে ডাকতো। বর্গিহানা এই সময় একপ্রকার বাৎসরিক ঘটনায় পরিণত হয়েছিল।
মারাঠি ধনগর জাতীয় লোকেরা অভিযানে যাওয়ার সময় কেবলমাত্র একটি সাত হাত লম্বা কম্বল ও বর্শা নিয়ে বের হত। এই বর্শাকে মারাঠি ভাষায় বলা হত ‘বরচি’। এই নাম থেকেই ধনগররা বারগির বা বর্গা ধনগর বা বর্গি নামে পরিচিত হয়। বর্গি শব্দটি মারাঠি বারগির শব্দের অপভ্রংশ। বারগির বলতে মারাঠা সাম্রাজ্যের সেই সব অশ্বারোহীদের বোঝাত। এরা ছিল ধনগর জাতীয় এবং মারাঠা নেতা ছত্রপতি শিভাজী মারাঠী প্রশাসন কর্তৃক এদের ঘোড়া ও অস্ত্র সরবরাহ করা হত। মারাঠারা প্রধানত ভারতের মহারাষ্ট্রের অধিবাসী হলেও তারা ভারতবর্ষের গোয়া গুজরাট কর্নাটক অন্ধ্রপ্রদেশ তামিলনাড়ু– ও মধ্য প্রদেশেও বাস করে। সনাতন ধর্মের অনুসারী মারাঠারা মুগল আমলে ছিল ক্ষত্রিয় যোদ্ধা।
মারাঠাদের অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন ছত্রপতি শিবাজী (১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৬২৭-এপ্রিল ৩, ১৬৮০); তিনিই ১৬৭৪ সালে মহারাষ্ট্রের মারাঠী সাম্রাজ্যটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । মারাঠী সাম্রাজ্য রাজধানী ছিল মহারাষ্ট্রের রাইগাড। ১৮১৮ অবধি মারাঠী সাম্রাজ্যটি টিকে ছিল। মারাঠী সাম্রাজ্য পতনের কারণ ভারতবর্ষে নতুন শক্তির আগ্রাসন।
মুগল সম্রাট আওরঙ্গজেব (নভেম্বর ৪, ১৬১৮-মার্চ ৩, ১৭০৭) সম্রাটের দক্ষিণ ভারতের সামরিক অভিযানের সময় মারাঠা সাম্রাজ্যটি ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে, যার ফলে মারাঠারা মুগল শাসনের প্রতি বিক্ষুব্দ হয়ে উঠে। যেহেতু মুগল আমলে মারাঠারা ছিল হিন্দু ক্ষত্রিয় যোদ্ধা সুতরাং সম্রাট আওরঙ্গজেব মনসব পদ দিয়ে মারাঠা সৈন্যদের মুগল সেনাবাহিনীতে অর্ন্তভূক্ত করে মারাঠাদের রোষ প্রশমিত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতে তেমন কোনো লাভ হয়নি। কিছু কিছু মারাঠা সেনাপতি সম্রাট আওরঙ্গজেব-এর অনুগত থাকলেও বেশির ভাগ মারাঠা সৈন্যই রোষবশত ভারতবর্ষে মুগল শাসিত প্রদেশগুলিতে লুঠপাঠ আরম্ভ করে। রোষের শিকার মুগল শাসিত প্রদেশগুলিতে সুবা বাংলা ছিল অন্যতম।
বাংলা মুগলশাসিত প্রদেশ বলেই ১৭৪২ থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত বার বার বাংলায় বর্গীদের আক্রমন সংঘটিত হতে থাকে। নওয়াব আলীবর্দী খান ১৭৪০ সালে বাংলার নওয়াব নিযুক্ত হন। ১৭৪২ সালের ১৫ এপ্রিল বর্গীরা বর্ধমান আক্রমন করে। জরুরি সংবাদ পেয়ে নওয়াব আলীবর্দী খান সসৈন্য বর্ধমানের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। বর্গীদের নেতা ছিল ভাস্কর পন্ডিত, তার নির্দেশে বর্গীরা নওয়াব-এর রসদ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ২৬ এপ্রিল বর্গী বেষ্টনী ছিন্ন করে কোনওমতে প্রাণে বাঁচেন নওয়াব ।
৬ মে, ১৭৪২। মুর্শিদাবাদের দ্বারপ্রান্তে সশস্ত্র বর্গীরা এসে উপনীত হল। নওয়াব আলীবর্দী খান সে সময় মুর্শিদাবাদে ছিলেন না। নির্মম বর্গীরা মুর্শিদাবাদ নগরের বড় একটি বাজার পুড়িয়ে দেয়। এবং এভাবে বর্গীদের নির্বিকার ধ্বংসযজ্ঞ বাংলার মানসে চিরতরে প্রোথিত হতে থাকে: যে রুদ্ধশ্বাস অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছিল মনোরম বিষন্ন একটি ছড়ার আকারে ...
৬ মে, ১৭৪২। মুর্শিদাবাদের দ্বারপ্রান্তে সশস্ত্র বর্গীরা এসে উপনীত হল। নওয়াব আলীবর্দী খান সে সময় মুর্শিদাবাদে ছিলেন না। নির্মম বর্গীরা মুর্শিদাবাদ নগরের বড় একটি বাজার পুড়িয়ে দেয়। এবং এভাবে বর্গীদের নির্বিকার ধ্বংসযজ্ঞ বাংলার মানসে চিরতরে প্রোথিত হতে থাকে: যে রুদ্ধশ্বাস অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছিল মনোরম বিষন্ন একটি ছড়ার আকারে ...
খোকা ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো
বর্গী এল দেশে,
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দেব কীসে?
বর্গী এল দেশে,
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দেব কীসে?
মুর্শিদাবাদ নগরে জগৎ শেঠ নামে এক ধনী সওদাগর বাস করতেন । বর্গীরা তার কাছ থেকে ৩ লক্ষ টাকা আদায় করে নেয়। পরের দিনই, অর্থাৎ ৭ মে নওয়াব আলীবর্দী খান মুর্শিদাবাদ উপস্থিত হন। ততক্ষণে মুর্শিদাবাদের অনেকটা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়খার করে বর্গীরা আরও দক্ষিণে পালিয়ে গেছে ।
১৭৪২ সালের জুলাই মাসে, অর্থাৎ মুর্শিদাবাদ আক্রমনের ২ মাস পর হুগলি জেলায় বর্গীরা একটি সৈন্য শিবির স্থাপন করে এবং খাজনা আদায় করতে লাগল। বর্গিদের একটা অংশ থেকে গেল এই হুগলী জেলায়। হুগলী জেলার সেই গ্রামের নামকরণ হলো "বর্গীডাঙ্গা '......
১৭৪২ সালের জুলাই মাসে, অর্থাৎ মুর্শিদাবাদ আক্রমনের ২ মাস পর হুগলি জেলায় বর্গীরা একটি সৈন্য শিবির স্থাপন করে এবং খাজনা আদায় করতে লাগল। বর্গিদের একটা অংশ থেকে গেল এই হুগলী জেলায়। হুগলী জেলার সেই গ্রামের নামকরণ হলো "বর্গীডাঙ্গা '......
রাধামাধব কুন্দন নামে এক বর্গীসেনা কেন বরগীডাঙ্গায় বসবাস শুরু করলেন তা ঠিক জানা যায়নি। এই রাধামাধব ই হলেন ইটাচুনার কুন্ডু পরিবারের প্রতিস্ঠাতা। কুন্দন পদবীর বাংলার মানুষের মুখে ধীরে ধীরে কুণ্ডুতে রূপান্তরিত হয়। এই কুন্ডু কিন্তু আমাদের বাংলার কুন্ডু নয়। রাধামাধব বর্গীডাঙ্গার উর্বর জমিতে চাষবাস শুরু করে থিতু হলেন। আর কিছুদিন পর রাধামাধবের এক বংশধর স্বপ্নে দেখেন বর্গীডাঙ্গার পাশেই ইটাচুনা গ্রামে এক জঙ্গলের মধ্যে অবহেলিত পরে আছেন তাঁদের ইষ্টদেবতা শ্রীধর জিউ। বিগ্রহ উদ্ধার করে প্রতিষ্ঠিত হলো শ্রীধরজিউ এর মন্দির ,এবং মন্দিরকে কেন্দ্র করে তৈরি হলো কুন্দন রাজবাড়ী। রাধামাধবের বংশধর সাফল্যরাম ১৭৬৬ সালে রাজবাড়ী নির্মাণ করলেন, এবং রাজবাড়িকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পেশার লোকজনদের নিয়ে গড়ে উঠলো ইটাচুনা গ্রাম। নির্মম লুঠেরা বর্গী-দস্যু কুন্দনরা হয়ে গেল আমাদের পাশের বাড়ির কুন্ডু।
সপ্তদশ ও অস্টাদশ শতকে বাংলার রেশমি কাপড়ের আড়ংগুলি (আড়ং শব্দটা ফারসি। আড়ং বলতে বড় আকারের বাজারকে বোঝায়) ছিল জমজমাট। বর্গী আক্রমনে আড়ংগুলি লোকশূন্য হয়ে পড়ে, আড়ংগুলি খাঁ খাঁ করতে থাকে। বাংলার অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়তে থাকে। বাংলাজুড়ে খাদ্যশস্যের অভাব দেখা দেয়, ব্যবসা-বানিজ্য বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। যা হোক। বর্গীরা চৌথ আদায় করতে থাকে এবং পুবের যশোর জেলা অবধি বর্গীদের খাজনা আদায় ক্রমেই সম্প্রসারিত হতে থাকে। বর্গীদের নির্মম অত্যাচারে বহু লোক ভিটেমাটির মায়া ত্যাগ করে গঙ্গার পূর্বাঞ্চলে ( বর্তমান বাংলাদেশে) চলে আসে। পূর্বাঞ্চলের বাঙালিরাও বর্গী লুন্ঠনের শিকার হয়।
সপ্তদশ ও অস্টাদশ শতকে বাংলার রেশমি কাপড়ের আড়ংগুলি (আড়ং শব্দটা ফারসি। আড়ং বলতে বড় আকারের বাজারকে বোঝায়) ছিল জমজমাট। বর্গী আক্রমনে আড়ংগুলি লোকশূন্য হয়ে পড়ে, আড়ংগুলি খাঁ খাঁ করতে থাকে। বাংলার অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়তে থাকে। বাংলাজুড়ে খাদ্যশস্যের অভাব দেখা দেয়, ব্যবসা-বানিজ্য বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। যা হোক। বর্গীরা চৌথ আদায় করতে থাকে এবং পুবের যশোর জেলা অবধি বর্গীদের খাজনা আদায় ক্রমেই সম্প্রসারিত হতে থাকে। বর্গীদের নির্মম অত্যাচারে বহু লোক ভিটেমাটির মায়া ত্যাগ করে গঙ্গার পূর্বাঞ্চলে ( বর্তমান বাংলাদেশে) চলে আসে। পূর্বাঞ্চলের বাঙালিরাও বর্গী লুন্ঠনের শিকার হয়।
বাংলাপিডিয়ায় মোহাম্মদ শাহ লিখেছেন, ‘ঘন ঘন মারাঠা হামলা বাংলাকে মহাবিপর্যয়ে নিপতিত করে। বাংলার জনগনের জন্য এটা এতটাই ধ্বংস আর দুঃখ বয়ে আনে যে, মারাঠা বর্গীদের হামলার ভীতিকর গল্প বাংলার শিশুদের ঘুমপাড়ানি গানে বিশেষ স্থান অধিকার করে। এর সাথে অজন্মা ও খরা মিলে বাংলার অবস্থা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে। মারাঠা হানাদাররা লুন্ঠন, অগ্নি সংযোগ ও হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে বাংলার জনগনের মনে এমনি ত্রাসের সঞ্চার করেছিল যে, বহুলোক তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে গঙ্গার পূর্বদিকের জেলাগুলিতে পালিয়ে যায়। এতে উক্ত এলাকার জনসংখ্যার চাপ বৃদ্ধি পেয়ে মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করে। মূল এই অর্থনৈতিক সংকটই পরবর্তী সময়ে বাংলার নওয়াবকে বিপর্যস্ত ও পর্যুদস্ত করে।’
বাংলার ইতিহাসে মীর জাফরের আগেও মীর হাবিব নামে বাংলায় আরও একজন বিশ্বাসঘাতক ছিল! পারস্য সেই অভিজাতটি এক সময় নওয়াব আলীবর্দী খানের ঘনিষ্ট ছিল; অথচ, এই লোকটিই লোকাল এজেন্ট হিসেবে বর্গীদের সাহায্য করত! আসলে মীর হাবিব ছিল রাজাকার; তার বাংলা সম্বন্ধে খুঁটিনাটি জ্ঞান ছিল। বর্গীরা সে জ্ঞান প্রয়োগ করে সহজেই বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত!
বাংলার ইতিহাসে মীর জাফরের আগেও মীর হাবিব নামে বাংলায় আরও একজন বিশ্বাসঘাতক ছিল! পারস্য সেই অভিজাতটি এক সময় নওয়াব আলীবর্দী খানের ঘনিষ্ট ছিল; অথচ, এই লোকটিই লোকাল এজেন্ট হিসেবে বর্গীদের সাহায্য করত! আসলে মীর হাবিব ছিল রাজাকার; তার বাংলা সম্বন্ধে খুঁটিনাটি জ্ঞান ছিল। বর্গীরা সে জ্ঞান প্রয়োগ করে সহজেই বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত!
১৭৪২ সালের মাঝামাঝি বাংলা থেকে বর্গীদের নিমূর্ল করার কঠিন সিদ্ধান্ত নেন নওয়াব আলীবর্দী। নওয়াবের এ সিদ্ধান্ত বাঙালিদের ভালোবেসে নয়, দিল্লির প্রাপ্য খাজনায় বর্গীরা ভাগ বসাচ্ছিল বলেই। ১৭৪৩ সালে বর্গীরা মেদিনীপুর আক্রমন করে। নওয়াব আলীবর্দীর নেতৃত্বে মুগল সৈন্যরা মেদিনীপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ৯ ফেব্রুয়ারি দুপক্ষের তুমুল সংর্ঘষ হয়। নওয়াব আলীবর্দীর উন্নততর রণকৌশলের ফলে মেদিনীপুর থেকে বর্গীরা উৎখাত হয়ে যায়। ১৭৪৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বর্গী নেতা ভাস্কর পন্ডিত আবার বাংলা আক্রমন করে বসে। নওয়াব আলীবর্দী খান বাধ্য হয়ে এবার ষড়যন্ত্রের পথ ধরেন। বর্গী নেতা ভাস্কর পন্ডিতকে বৈঠকের আহবান জানান। বৈঠকে ২১ জন বর্গীসহ ভাস্কর পন্ডিত এলে তাঁবুর আড়ালে লুকিয়ে থাকা মুগল সৈন্যদের আক্রমনে বর্গীরা নিহত হয়। ১৭৫০ সালের বর্গীরা আবার বাংলায় হানা দেয়। ১৭৫১ সালে বর্গী আক্রমনের তীব্রতা এতই বেড়ে যায় যে, নবাব আলীবর্দী খানকে মারাঠা-বর্গীদের সঙ্গে সন্ধিচুক্তি করেন। এই সন্ধিচুক্তি অনুযায়ী তিনি উড়িষ্যার অধিকার ছেড়ে দেন। চুক্তির শর্তানুসারে মীর হাবিব নওয়াবের কর্মকর্তা হিসেবে পরিগণিত হবেন এবং উড়িষ্যায় নওয়াবের নায়েব নাজিম বা ডেপুটি গভর্নরের দায়িত্ব পালন করবেন; আলীবর্দী মীর হাবিবের জন্য উড়িষ্যায় ১২ লক্ষ টাকা চৌথ পাঠাবেন এবং প্রদেশের রাজস্বের উদ্বৃত্ত টাকা রঘুজীকে পাঠাবেন। এ চুক্তি অনুসারে ভবিষ্যতে আর কখনও যেন আলীবর্দীর এলাকায় হানাদার মারাঠাদের পদার্পণ না ঘটে মারাঠা সরকার সেই অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। কিন্তু ১৭৫২ সালের ২৪ আগস্ট মারাঠা সৈন্যদের হাতে মীর হাবিব নিহত হলে আলীবর্দী উড়িষ্যায় তাঁর নিয়ন্ত্রণ হারান এবং প্রদেশটিতে পুনরায় মারাঠাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
আর তার মাত্র ৬ বছর পর ইংরেজদের করতলগত হয়ে যায় বাংলা । ওদিকে মারাঠা-বর্গীরা মুগলদের পরির্বতে নতুন এই শক্তির মুখোমুখি হতে হয়- যে শক্তিটি মুগলদের চেয়ে সহস্রগুণ চতুর খল ও শক্তিশালী।
আর তার মাত্র ৬ বছর পর ইংরেজদের করতলগত হয়ে যায় বাংলা । ওদিকে মারাঠা-বর্গীরা মুগলদের পরির্বতে নতুন এই শক্তির মুখোমুখি হতে হয়- যে শক্তিটি মুগলদের চেয়ে সহস্রগুণ চতুর খল ও শক্তিশালী।
কুন্দন বা কুন্ডু পরিবারের বর্তমান প্রজন্মের উদ্যোগে বনেদিয়ানা ও বৈভবে ভরপুর রাজবাড়ীর অন্দরমহল বর্তমানে গেস্টহাউস। এই বনেদিয়ানা , বৈভব ও ই ‘ইটাচুনা রাজবাড়ী’। বর্তমান হুগলীর মগরার কাছে অবস্থিত এই রাজবাড়ী এখনও রাজাদের আবাসস্থল এবং পান্থের পান্থশালা। ছেলেবেলা থেকে রাজবাড়ীর কথা শুনে আসছি, ইচ্ছে হল রাজ অতিথি হবার ।২০১৫ সালে সুযোগ ও এসে গেল একদিন, আমার স্ত্রী স্বাতী কয়েক দিনের জন্য বাপের বাড়ি গেল।প্রোগ্রাম বানিয়ে বেরিয়ে পরলাম,একা ।
বর্ষার সকাল, আকাশের রঙ যত্ন করে মোছা শ্লেটের মতো চকচকে কালো। এখন বৃষ্টি হচ্ছেনা ঠিকই, কিন্তু বাতাসে জলকণার বাড়াবাড়ি চারপাশটাকে ধোঁয়াটে, ঘোলা ঘোলা করে রেখেছে। সারারাত বৃষ্টিতে ভিজে গাছেরা এখন গা ঝাড়া দিয়ে জল ঝড়িয়ে নিচ্ছে। গাছ গুলোর তলায় দাঁড়ালে মনে হতেই পারে যে বৃষ্টি বোধহয় এখনও থামেনি। নেমেছি খান্নান স্টেশানে। স্টেশান থেকে বেরিয়েই বাজার। বাজারে শহুরে জিনিসের অভাব না থাকলেও শহুরে ব্যাস্ততাটা এখানে অনেকটাই ফিঁকে। ৯ টা বেজে গেছে। কিন্তু বাজারটা এখনও তেমন জমে ওঠেনি। ফাঁকা ফাঁকা ঢিলে ঢালা ভাব। বৃষ্টির জন্যই হয়তো এরকম অবস্থা। বাজারের মধ্যেই টোটো স্ট্যান্ড। এই বিজলী রিকশা এখন বিভিন্ন নামে শহরতলী আর মফঃস্বল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এখানেও তার জমকালো উপস্থিতি। তবে এখানকার টোটো চালকদের যাত্রী ধরার হুড়োহুড়ি চোখে পড়ল না। একটা ঝকঝকে টোটো চোখ টানল। তাতে বাজছে চটুল হিন্দি গান – বেশ উচ্চ স্বরে। আর তার চালক সিটের ওপর পা গুটিয়ে বসে সুখটানে মত্ত। “যাবে?” – আমার প্রশ্নে অবাক হয়ে , আমার দিকে একটা অবহেলার দৃষ্টি বুলিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছাড়ল। বোঝা গেল একা আমার জন্য এই সুখের আমেজ সে কোনভাবেই নষ্ট করতে চায়না এবং আমার এই অকিঞ্চিতকর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনও সে মনে করে না। এর মধ্যে আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মাথায় ছাতা। প্যাচপ্যাচে কাদা রাস্তা। হাঁটু অবধি গোটানো প্যান্ট। পিঠে ব্যাগ। তাগিদটা তাই আমার-ই বেশী। আশপাশের টোটো-ওয়ালাদের অবস্থাও প্রায় এক। সবারই গয়ংগচ্ছ ভাব। ঠুনকো অপমানের বোঝা বাড়িয়ে আর কষ্ট পাই কেনো। টোটো চালকের অবজ্ঞা উপেক্ষা করে গলাতে মিষ্টি রস ঢেলে বললাম – “ দাদা ইটাচুনা রাজবাড়ি যাবো। কতো ভাড়া?” – এই কথাতে ঘটে গেল একটা ম্যাজিক। আধ খাওয়া বিড়িটা দূরে ছুড়ে দিয়ে, ঝট্ করে পা টা নামিয়ে, এক মুখ হেঁসে বিনয়ে ঘাড়-টার কাত করে বললো – “ বসুন বসুন। ১০ টাকা দেবেন’খন ।” বোঝা গেল, রাজাদের রাজত্ব না থাকলেও রাজবাড়ির সম্মানটা এখনও এখানে অটুট।
টোটো চলেছে বাজার ছাড়িয়ে। বেশ চওড়া পিচের রাস্তা। বর্ষার অত্যাচারে দু-এক জায়গায় ক্ষত হলেও যথেষ্ট স্বাস্থ্যবতী। রাস্তার দুধারে বড় বড় মূল্যবান সব গাছ রাস্তার ওপর ঘন সবুজ শামিয়ানা টানিয়ে রেখেছে। আর বৃষ্টির জলে ধুয়ে ধুয়ে এই সবুজ শামিয়ানার কোথাও এক ছিঁটে ময়লা নেই। কলকাতার ধোঁয়াটে বর্ষা দেখা চোখ এরকম অমলিন, কোমল, সিক্ত শ্যামলতা দেখে বেশ আরাম পাচ্ছে।
-“স্যার; রাজবাড়িতে কি ঘুরতে?” টোটো চালক ঘাড় ঘুরিয়েছে।
-“ হ্যাঁ ”।
-“ কদিন থাকবেন? ”
-“ কালই চলে যাবো। আজকের রাতটা শুধু। ”
-“ একা একাই এসেছেন? ”
-“ হ্যাঁ – একাই। এই ভরা শ্রাবণে রাজবাড়ি দেখার সঙ্গী আর পেলাম কই!”
-“ হা: হা:। তা ঠিক স্যার। শীত কালে প্রচুর লোক আসে এখানে। এই সময় প্রায় আসেই না বলতে গেলে।”
-“ হুম ”। বিদেশী বিপণনের হাত ধরে এখন যেখানে সেখানে, যখন তখন স্যার ডাকের ছড়াছড়ি।
-“ জানেন স্যার ”; আবার শুরু হল। “এই রাজারা খুব ভালো। এখানকার জন্য অনেক কিছু করেছেন। বাঁদিকে দেখুন স্যার – স্কুল, মেয়েদের। পাশেরটা ছেলেদের। একদম ক্লাস ১২ অবধি। এটা হোস্টেল।” দেখলাম বেশ বড়সড় হস্টেল।ছাত্র সংখ্যা যে খুব খারাপ নয় সেটা বোঝাই যায়। “ এটা কলেজ।” – আমার পথপ্রদর্শকের প্রদর্শন এখনো শেষ হয়নি।“ রাজার নামেই এই কলেজ। ডান দিকে দেখুন হসপিটাল। এই রাজারাই আমাদের এলাকাটাকে আশেপাশের থেকে অনেক উন্নত করে দিয়েছে। কত সিনেমার শুটিং হয় এখানে। রাজবাড়ীতে তো হয়ই।” এরপর শুরু হয়ে গেল সিনেমার লম্বা লিস্ট। অত নাম শোনার ইচ্ছে আর ধৈর্য কোনটাই আমার নেই আপাতত। হ্যাঁ হুঁ করে চললাম।
এতক্ষণে রাজবাড়ীর নাম শুনেই টোটো চালকের ভোল বদলের রহস্যটা আমার সামনে পুরো পরিষ্কার হয়ে গেল। এখানকার লোকেরা তাদের রাজাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। আর রাজারাও আদতে লুঠেরা হলেও কৃতঘ্ন নয়। তারা প্রজাদের ওপর যথেচ্ছ শোষণের প্রতিদান দিতে ভোলেনি। প্রাচীন বর্বরতার কালিমা মুছে রাজারা এখানে সত্যিই প্রজাপরায়ণ।
“ এই যে স্যার এসে গেছি ” – চমক ভাঙল। “ দরকার হলে ডাকবেন স্যার। এই যে কার্ড। আর একটু সাবধানে থাকবেন স্যার। বর্ষার দিনতো।” টাকা নিয়ে, নিজের নাম ছাপা কার্ড আমার হাতে ধরিয়ে টোটোওয়ালা বিদায় নিল।
বৃষ্টিটা একটু ধরেছে। সূর্যও মেঘের ফাঁক দিয়ে আলগোছে উঁকি দিয়ে নিজের অস্তিত্ব বোঝাচ্ছে। একটা জোলো হাওয়া হঠাৎ হঠাৎ করে এসে ভেজা গায়ে শিরশিরাণি তুলছে। আর আমার সামনে এখন এক বাস্তব ইতিহাস। দাঁড়িয়ে আছি ইটাচুনা রাজবাড়ীর সামনে। প্রথমেই একটা ছোট বাগান – সাজানোর চেষ্টা হয়েছিল ঠিকই কিন্তু বর্ষার জলের গুণে আগাছারাই এখন দলে ভারী। বাগানের তিন দিক ঘেরা সুবিশাল অট্টালিকা – সত্যি করেই রাজবাড়ী। বেদানার মতো লাল টকটকে। দোতালা। রাস্তার ঠিক মুখোমুখি কিছুটা অংশ সাদা – তবে শ্বেতপাথরের নয় – চুনকাম করা। এটাই রাজবাড়ীর মুল ফটক। এই ফটকের দুইপাশে দোতালা পর্জন্ত জোড়া থাম উঠে গেছে। তার মাথায় ত্রিভুজাকৃতি তোরণ। গতধরা প্রাচীন ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীর উদাহরণ।
রাস্তা থেকে রাজবাড়ীর সিংহদ্বার অবধি সোজাসুজি কোনো রাস্তা নেই। বাগানকে বাঁয়ে বা ডানে রেখে ঘুরে গিয়ে পৌঁছতে হবে প্রবেশদ্বারে। এই অংশটা রাজবাড়ীর বাহির মহল। এখানেই বাগানের বাঁদিকে রাজবাড়ীর অফিস। বাগানকে ডানে রেখে চলে এলাম সেখানে। খাতায় কলমে রাজবাড়ীর অতিথি হিসাবে নিজেকে নথিভুক্ত করে নিলাম। অফিস ঘরে রাজবাড়ীর একটা ফ্রেম বাঁধানো ছবি ছাড়া আর কিছুই রাজকীয় নয়। মনটা একটু দমে গেল। অফিস ঘর এতো সাদামাটা; ভেতরটা আর কী এমন আহামরী হবে! কিন্তু আমার এই ভাবনাকে থমকে দিয়ে অফিস ঘরে প্রবেশ করেছে এক ঐতিহাসিক চরিত্র। গায়ে ফতুয়া, মালকোচা দেওয়া ধুতি; মাথায় আবার পাগড়ী; আর পায়ে খড়ম। অষ্টাদশ শতকের রাজবাড়ির কর্মচারীরা বোধ হয় এরকমই হত। এই মূর্তিমান ইতিহাস বেশ ঝুঁকে আমায় প্রণাম জানালো এবং আমার ব্যাগটা তুলে নিয়ে এগিয়ে চললো রাজবাড়ীর মূল ফটকের দিকে। আমিও তাকে অনুসরণ করলাম।
অফিস ঘরের সাদামাটা অবস্থা দেখে আমার মনে যে দুশ্চিন্তার চোরাস্রোত বইতে শুরু করেছিলো তা পুরোপুরি চাপা পড়ে গেল মূল রাজবাড়ীর ভেতর ঢুকে। মূল ফটক পেরিয়েই এসে পড়লাম লাল সিমেন্ট বাঁধানো একটা বিরাট চৌকো চাতালে। এর ঠিক মাঝখানে সাদা আলপনা; বৃষ্টির জলে ধুয়ে ধুয়েও এখনও সবটা মুছে যায়নি। সারি সারি নকশাওয়ালা কালো কালো বাতিস্তম্ভ সারা চাতালে ছড়ানো। এই চত্বরটা এতোটাই বড়ো যে এখানে একটা ছোট হাউসিং কমপ্লেক্স তৈরি হতে পারে। এই চত্বরকে ঘিরে রেখেছে দ্বিতল রাজবাড়ী। দোতালায় রেলিং দেওয়া বারান্দা আর টানা ঘর। একতলার বারান্দা গুলো রেলিং ছাড়া। একতলাতেও দোতলার মতো ঘরের সারি। সব ঘরই বন্ধ। মূল ফটকের ঠিক অপরপ্রান্তে চাতালের শেষে অবস্থান করছে এক বিরাট মন্দির। নিঃসন্দেহে রাজাদের গৃহদেবতা। আমার পথপ্রদর্শককে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল এই মন্দিরে রাধা-কৃষ্ণের অধিষ্ঠান। পথপ্রদর্শকের নামটাও এর মধ্যে জেনে ফেলেছি – কমল।রাজকর্মচারীদের মতই গাম্ভীর্য আর প্রশ্নের উত্তরে বেশী শব্দের ব্যাবহার এর নীতিবিরদ্ধ। কমল এখন আমাকে আর মন্দিরের দিকে না নিয়ে গিয়ে ডানদিকের একটা ছোট দরজা দিয়ে নিয়ে এলো একদম অন্দরমহলে। এই অন্দরমহলের মাঝখানেও সিমেন্ট বাঁধানো উঠোন। তবে এটা অনেক ছোট। বাইরের চাতালের এক চতুর্থাংশ। এই উঠোনের চারপাশ দিয়ে ঘর। বাড়িটা দোতালা।
এরকম তিনমহলা বাড়ি দেখার অভিজ্ঞতা আমার প্রথম। ভাবতে অবাক লাগে এতো বড়ো বাড়ি নিশ্চয়ই রাজাদের রাজত্বকালে কোলাহল মুখরিত ছিল। কতো হাসি-কান্না, রাগ-অভিমান, হিংসা-ভালোবাসার স্মৃতি জড়িয়ে আছে এর মোটা মোটা লাল দেওয়ালের আনাচে কানাচে। আজ সব ফাঁকা, শুনশান, নিঃশব্দ; লোকজনেরও দেখা নেই। এতো বড়ো রাজবাড়ীতে এখনও পর্যন্ত মাত্র দুজন মানুষকে দেখলাম। এক ঐ অফিসের অফিসবাবু আর দুই আমার পথপ্রদর্শক কমল। আমাকে চাতালে এনে দাঁড় করিয়ে রেখে সেও কোন গোপন কুঠুরীতে আত্মগোপন করেছে।
এই চতুর্ভুজ একতলাটার দুই বাহুতে থাকার ঘর। আর অবশিষ্ট দুই বাহুর একটা মনে হয় রান্নাঘর আর অন্যটায় খাবার ঘর। রান্নাঘর আর খাবার ঘরে একাধিক দরজা। তার একটা দিয়ে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল কমলকে। হাতে একটা পাত্র। অত্যন্ত পুরানো। এখনকার দিনে ওরকম পাত্র দেখাই যায়না। তাই নাম জানারও প্রশ্নই ওঠেনা।
“ স্যার, পা ধোয়ার জল এনিচি; পা টা ধুয়ে নিন।”
কানে কট্ করে লাগলো কথাটা। বেশ একটা পুরোনো সময়ে চলে গেছিলাম। ‘স্যার’ কথাটা যেন টাইম মেশিনের হ্যান্ডেলটাকে এক ঝটকায় ঘুরিয়ে একবিংশ শতকে ফিরিয়ে আনল। বড্ড বেমানান।
পা ধুয়ে প্রবেশ করলাম অন্দরমহলের অন্দরে। পরিপাটি করে সাজানো বসার ঘর। উপর থেকে ঝুলছে চাইনিজ ঝাড়বাতি। বসার জন্য রাজকীয় সোফা – নতুন করে তাতে পালিশ পরেছে। সোফার নরম গদিতে শরীর ছেড়ে দিতে না দিতেই পোশাকে প্রাচীন বয়সে নবীন এক চরিত্রের প্রবেশ। আমার দেখা রাজবাড়ীর লোক সংখ্যা দুই থেকে তিন হলো এবার। এর হাতে পিতলের রেকাব – তার উপর বসানো পিতলের পানপাত্র। অতিথিকে আপ্যায়ন জানানোর রাজকীয় প্রথা। রাজবাড়ির সুদৃশ্য পানপাত্র শুনে হয়তো পাঠকের প্রত্যাশাটা একটা অন্য খাতে বইতে শুরু করতে পারে। কিন্তু এই পানপাত্র নুন-লেবু-চিনির অতি পরিচিত সরবতেই পরিপূর্ণ। অন্যরকম পানীয়ের কল্পনা সম্পূর্ণই অমূলক।
আমার জন্য নির্ধারিত হয়েছে ‘ছোট পিসির’ ঘর। কমলের মুখে কথাটা শুনে অবাকই হলাম। ছোট পিসি আমার ওপর দয়াপরবশ হয়ে আজকের রাতটা নিজের ঘর ছেড়ে দিয়েছেন, না কি? না তা নয়। কমল আমাকে আশ্বস্ত করল ওটা নামেই ছোট পিসির ঘর। কিন্তু রাজাদের এই ছোট পিসি কোথায় থাকেন বা আদতে আছেন কিনা সে প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ অবান্তর। এখানকার সব অতিথি আপ্যায়ণের ঘরের নামের সঙ্গেই এবাড়ির বাসিন্দাদের – ‘ বড় বৌদি’, ‘ ছোড়দা’, ‘ঠাকুমা’ নিত্য যোগাযোগ।
কমলের সাথে উঠে এলাম দোতলায়। সিঁড়িটা এসে শেষ হয়েছে চতুর্কোণ দোতলার এক কোণে। এর দুই দিকে দুই বাহু। আমরা ডানদিকের বাহু দিয়ে এগোলাম। লম্বা করিডর। তার ডানপাশে ঘর আর বাঁপাশে বারান্দা। করিডোরে সুসজ্জিত বিলাস বহুল সোফা পাতা। একেকটা একেক রকম। অপূর্ব কারুকাজ। অঙ্গসজ্জায় একে অপরকে প্রাণপণ টেক্কা দেওয়ার চেষ্টা করছে। এতো রকমের বসার আসবাব যে হয় তা আমার ধারণার বাইরে ছিল। বসার থেকে এগুলো দেখেই বেশী আনন্দ পাওয়া যায়। করিডরের বারান্দার দিকের জানালায় রঙ্গিন কাঁচ। সেইসব কাঁচ ভেদ করে আসা রঙিন আলো জায়গাটাকে মায়াবী করে রেখেছে। করিডর এর বারান্দার দিকের দরজা দিয়ে এসে দাঁড়ালাম রেলিং ঘেরা বারান্দায়। রেলিং ধরে ঝুঁকলে নিচের উঠোন দেখা যায়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলাম চতুর্ভুজ দোতলার তিন ভুজের নকশা একই রকম। এই তিন দিক জুড়েই পরপর বারান্দা, করিডর আর ঘর। আর আমার ডানপাশে, দোতলার একদিক জুড়ে খোলা ছাদ। বারান্দা দিয়ে চলে এলাম খোলা ছাদে। বৃষ্টির জলে জায়গাটা পিছল। আর এখানে ভিড় জমিয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির অর্কিড। তাদের কোনটাতে আবার ফুল ফুটেছে। ছাদ পেরিয়ে আবার একই রকম বারান্দা, করিডর, ঘর। দোতালাটা পুরোটাই সংযুক্ত। পুরোটা চক্কর দিয়ে আবার প্রথম দেখা করিডোরেই ফিরে এলাম। এখানে পর পর তিনটে ঘরের মধ্যে দুটি বন্ধ আর মাঝেরটা খোলা। দরজায় ভারী পর্দা ঝুলছে। দরজার পাশের দেওয়ালে কায়দা করে লেখা ‘ছোট পিসির ঘর’। তাহলে এই ঘরটাই আজকে রাতে আমার ঠিকানা।
পা দিলাম ঘরের ভেতরে। সিনেমায় দেখা রাজবাড়ীর সাথে হুবহু মিল। মোটা মোটা দেওয়াল। হলদেটে আলোয় ঘরটা মাখামাখি হয়ে আছে। অদ্ভুত রকমের ঠাণ্ডা মেঝে। মার্বেল পাথরের। সাদা কালো ছক মেলানো। ঘরটা পেল্লায় রকমের বড়। শপিং মলের ফুড কোর্ট এর মধ্যে সহজেই ঢুকে যেতে পারে। প্রায় আড়াই মানুষ সমান উঁচু সিলিং। ওপর থেকে নেমে আসা রড থেকে ঝুলে ঘুরছে ইলেকট্রিক ফ্যান। হাতে টানা পাখার বন্দোবস্ত থাকলেও তা নেহাতই স্মৃতিচিহ্ন। ঘরের ডানদিকটা পুরোটা জুড়ে রয়েছে একটা পালঙ্ক – সত্যি পালঙ্ক বলতে মনের মধ্যে এরকমই ছবি ফুটে ওঠে। চকচকে কালো মেহগনী পালিশ। অপূর্ব তার কারুকাজ। এর অঙ্গ জুড়ে জড়িয়ে থাকা ব্রীড়া, তনু বিভঙ্গ মনকে মুগ্ধ করে। আর এটা এতোটাই বড় যে এতে তিন-চার জন লোক অনায়াসে শুতে পারে। এই পালঙ্কের সাথের দেওয়াল জুড়ে দেওয়াল আলমারি। এই আলমারীর পালিশ এবং কারুকাজে পালঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। ঘরের বাঁদিকে ড্রেসিং টেবিল, লেখার টেবিল, ওয়ারড্রব দেওয়াল ঘেঁসে পাশাপাশি রাখা। এরাও যথেষ্ট সুন্দরী এবং ঘরের মানানসই। ঘরের মাঝখানে পাতা কার্পেট। তাকে ঘিরে গদি আঁটা সুদৃশ্য চেয়ার সাজিয়ে বসার জায়গা করা রয়েছে। প্রত্যেকটা আসবাবই বেশ পুরনো কিন্তু তাদের গা দিয়ে এখনও আলো পিছলে যায়। অর্থাৎ নিঃসন্দেহে এরা সযত্নে লালিত। দেওয়ালে ঝুলছে একটা ওয়েল পেন্টিং। এক মহিলার। রাজাদেরই কেউ হবেন হয়তো। হয়তবা ‘ছোটপিসির’ যৌবনই এখানে ফ্রেম বন্দি। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন একটা থামের গায়ে হেলান দিয়ে। শিল্পের দিক থেকে এই ছবি খুব উঁচূ মানের না হলেও এটা নিঃসন্দেহে ঘরের আভিজাত্য কয়েকগুণ বাড়িয়ে তুলেছে।
ঘরেরই একটা চেয়ারে বসলাম বেশ আরাম করে। এই সময় একটু চা যদি পেতাম, মন্দ হতনা। কিন্তু বলবই বা কাকে। কমলতো ঘর গুছিয়েই বেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। এরকম একটা বিলাসবহুল সেকেলে জমিদার বাড়িতে বসে মনটা বেশ অন্যরকম হয়ে গেছে। এই অনুভুতিটার জন্যইতো এতো কষ্ট করে বৃষ্টি মাথায় করে এখানে আসা। আশা করি দিনটা যাবে না, বেশ ভালোই কাটবে। “আপনার চা” – কমলের ডাকে ঘর ভাঙল। এক্ষুনি ভাবছিলাম চায়ের কথা, আর চা নিয়ে হাজির। মন পড়তে পারে নাকি! যখন যা চাইব বলে ভাবছি সেটা নিয়েই হাজির হয়ে যাচ্ছে। এই লোকটা বেশ অবাক করছে। একে কথা তো প্রায় বলেই না। তার ওপর আদ্যিকালের পোশাকে মোড়া রোগাটে ক্ষয়াটে চেহারা। দেখে মনে হয় যেন রাজবাড়ির প্রথমদিন থেকেই এই লোক একই ভাবে নীরবে কাজ করে চলেছে। এ যেন জন্ম মৃত্যুর ঊর্ধে। রাজবাড়িতে এর উপস্থিতি যেন কেউ টলাতে পারেনি। শুধু রাজবাড়ির এই দুর্দিনে এর মুখে পড়েছে একটা মলিন ছায়া। বর্ষামুখর দিনে পুরনো রাজবাড়িতে এরকম একটা চরিত্রের উপস্থিতি বেশ উপভোগ্য গা ছমছমে ভাবের সঞ্চার করেছে।
চা টা শেষ করে স্নানের তোড়জোড় শুরু করলাম। ১২ টা বেজে গেছে এর মধ্যেই। ঘরের সাথেই বাথরুম। কাঠের মোটা পাল্লার দরজা। ঢুকলাম ভেতরে। এর যা সাইজ তাতে করে এতে ছোট ফ্ল্যাটের একটা বেডরুম অথবা বড়ো ফ্ল্যাটের একটা গেস্টরুম বানানোই যায়। কিন্তু রাজবাড়ি বলে কথা। তার বাথরুমটাও তো রাজকীয় হওয়া চাই। তবে এর অঙ্গসজ্জায় কোন প্রাচীনতা নেই। পুরোটাই আধুনিক ব্যাবস্থা। প্যাচপ্যাচে ঘাম আর বৃষ্টি ভেজা শরীর কৃত্রিম বৃষ্টিধারায় পেতে দিলাম – আহঃ! কী আরাম। কানে ভেসে আসছে সুরেলা মার্জিত কন্ঠের উৎকৃষ্ট ঠুমরী – ‘ননদিয়া কাঁহে মোরে বোল’। বেশ পুরনো দিনের মার্জনা। রেকর্ড বাজছে কোথাও হয়ত। ঘর থেকে শোনা যায়নি কিন্তু বাথরুম থেকে বেশ স্পষ্ট।
ফিটফাট হয়ে বসতে না বসতেই দরজায় টক টক। যথারীতি কমল। “আসুন। ভাত বেড়িচি।” একতলা খাবার ঘরে এলাম। সাবেকি আমলের চেয়ার টেবিল, জল ঢাকা কাঁসার গ্লাসে। খাবারও এল কাঁসার থালা বাটিতে রাজবাড়ির সম্মান বজায় রেখে। বাটি ভাত। তার পাশে কাত করে রাখা দুটো লুচি। থালার আশ পাশ দিয়ে সাজানো হতে লাগলো ষোড়শ উপাচার। পাতে পড়ল ঘি। তারপর শুক্তোয় মুখ তিতো করে সুগন্ধি মুগডালে গলা ভিজিয়ে, আরো সব ব্যঞ্জন সামলে যখন মাংসের বাটির দিকে হাত বাড়ালাম ততক্ষণে পেট ভরেই গেছে প্রায়। অবশ্য বাদ প্রায় কিছুই দিলাম না। দই মিষ্টি পর্্যন্ত চেটেপুটে খেয়ে নিলাম। রাজবাড়ির রাজকীয় ভোজ – অতুলনীয়। ঝিরঝিরে বৃষ্টিটাও আবার শুরু হয়েছে। ভেজা ভেজা ঠান্ডা ঠান্ডা আমেজ। ‘ছোটপিসি’র পালঙ্কটা যেন ডাকছে। কমল বলেছে বিকেলে পুরো বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখাবে। এখনও তার অনেক দেরী। অতএব ছোট করে একটা ভাত ঘুম সেরে নেওয়াই যায়।
বিকেলে বৃষ্টিটা আর নেই। সারাদিন মুখ লুকিয়ে থেকে দিনমণি শেষ বেলায় আশ মিটিয়ে পৃথিবীটাকে দেখে নিচ্ছেন। একটা লালচে হলদে আলো চারিপাশে। ভেজা মাটি থেকে ভাপ উঠে চারিপাশ ধোঁয়া ধোঁয়া। কমলের সাথে ঘুরে বেরাচ্ছি বাড়ির আনাচ কানাচ। রাজবাড়ির বাইরের অংশে পূজা মন্ডপ, ক্ষেত, পুকুর সবই আছে। বাড়ির ভেতরের অংশেও প্রচুর ঘর, বারান্দা – বিভিন্ন রকমের, বিভিন্ন ধরনের। স্পষ্টতই সুন্দর এবং প্রাচীনত্বের ছোঁয়ায় ভরপুর। তবে চোখে পরার মতো হলো একটা দাবার বোর্ড – বরং বলা ভালো দাবার টেবিল। টেবিল জোড়া দাবার ছক। সাদা কালো মার্বেল পাথরের ছক কাটা। অসম্ভব রকমের সুন্দর। আর এতোটাই বড় যে এর এক প্রান্তে বসে আরেক প্রান্ত ছুঁতেই পারা যায়না। গুটিগুলোও মার্বেলের। প্রায় এক ফুট করে লম্বা। আর ছক মেলানো মার্বেলের বারান্দার শেষ প্রান্তে পেতে রাখা এই দাবার ছক একে অপরের সৌন্দর্যকে দ্বিগুণ করেছে। স্মার্টফোন স্ক্রিনে বাঁধা দাবার ছক দেখা চোখ এই বিশালত্বের সামনে হতবাক হতে বাধ্য। এই বারান্দার অপর প্রান্তে ছাদে ওঠার সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে ছাদে। ছাদটা নিঃসন্দেহে বিরাট। রাজবাড়ির তিনটে মহল জোড়া ছাদ। পুরোটা ঘুরে আসতে হলে পায়ের বেশ ধকল সইতে হবে। এই ছাদে আগে কখনও না এলেও মনে হয় যেন খুব চেনা। বুক সমান উঁচু পাচিল; ছোট ছোট করে ভাগ করা। বহু সিনেমায় এরকম ছাদই ঘটনার ঘনঘটায় ঘনঘোর হয়ে ওঠে। ছাদের আলসেতে ভর করে দূরে তাকালে দৃষ্টি দিগন্ত ছুঁয়ে আসে। ক্ষেতের ধারে একটা বড় ফুলে ফুলে হলদে হয়ে থাকা রাধাচুঁড়া গাছের মাথায় আগুন জ্বালিয়ে আজকের মত পথ চলা শেষ করল ক্লান্ত, সিক্ত সূর্য। শাঁখ বেজে উঠল – বোধ হয় নিচের রাধা গোবিন্দ মন্দিরে। “চলুন এবার নিচে যাই। আরতি শুরু হবে মন্দিরে” – অনেকক্ষণ বাদে কমল মুখ খুলেছে।
মন্দিরে অলঙ্কার বিভূষিত, ফুলমালা শোভিত, চন্দন চর্চিত, সুসজ্জিত রাধাকৃষ্ণ পরষ্পরের আলিঙ্গনাবদ্ধ। বয়স্ক পুরোহিত ভক্তিতে অবিচল এবং যত্ন পরায়ণ। কাঁসর সহযোগে আরতি বেশ জমে উঠেছে। আমার উপস্থিতি নিশ্চয়ই পুরোহিত মহাশয়ের উৎসাহ কিছুটা বাড়িয়ে তুলেছে। কারণ এখানে আমিই একমাত্র বহিরাগত এবং আতিথি। সকাল থেকে এবাড়িতে এসে আমায় সব থেকে অবাক করেছে এর নির্জনতা। লোক প্রায় নেই। কাউকে দেখাই যায়না। এখনও অবধি আমি ঠাকুর মশাই কে নিয়ে হাতে গুনে চার জনকে দেখেছি। তাও যেন যন্ত্রচালিত পুতুল। হঠাৎ হঠাৎ করে মাটি ফুঁড়ে সামনে হাজির হয়। তারপর নিজের কাজটা করেই আবার অদৃশ্য হয়ে যায়। কোন কথা নেই মুখে। এক কমল আর দুই অফিস বাবু ছাড়া আর কাউর মুখে আমি কোন কথা শুনিনি। কোন গোপন মন্ত্রের আবেশে আবিষ্ট কিছু লোক যেন ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে এসে দীর্ঘ দিন ধরে একই ভাবে, একই লয়ে, একই ছন্দে, একই রকম কাজ করে চলেছে। সুদূর অতীত থেকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতেও কোন রকম বদল না ঘটেই যেন চলতে থাকবে এই জীবন্ত প্রাচীনতা – অপার স্তব্ধতা।
চা ঘরটা বেশ সুন্দর। ছাতিম তলায়। খড়ের ছাউনি। মাটির দাওয়া। সুদৃশ্য চিনামাটির কাপ প্লেটে চা – গ্রীন টী। বিলাসিতার পালিশে কথাও ধুলো জমার সুযোগ নেই। মন্দিরের আরতি শেষ অবধি দেখার মতো ধৈর্য আর আমার ছিলনা। পিপাসার্ত হয়ে পড়েছিলাম। কমল যথারীতি আমার মন পড়ে ফেলে চা-ঘরে নিয়ে এসেছে। আমায় চা বানিয়ে দিয়ে নিজে এখন একটা দেওয়ালের আড়ালে ধোঁয়া বিলাস করে নিচ্ছে। নিজের শরীরটা লুকিয়ে ফেলেছে ঠিকই কিন্তু ধোঁয়া আর কি করে লুকোবে। দেওয়ালের পিছন থেকে ফুর ফুর করে ধোঁয়া উঠছে।
চা শেষ করে পায়ে পায়ে ঘরে এলাম। এত বড় বাড়ি; এত বড় ঘর; নিস্তব্ধতা; নির্জনতা বেশ একটা আবেশ তৈরী করেছে মনের ওপর। বাথরুমে ঘুরে এলাম। এখনও রেকর্ড বাজছে শোনা যাচ্ছে। আর একই গান। একই গান এতো বার কেউ শোনে? সে যতই ভালো গান হোক। কী জানি কি ব্যাপার? বাথরমের দরজাটা একটু খুলে রাখলাম। যদি ঘর থেকে শোনা যায় গানটা। তাহলে এই নিশ্ছিদ্র নির্জনতায়, বর্ষণমুখরতায়, রাজবাড়ির এক রাজকীয় ঘরে বসে দূর থেকে ভেসে আসা ঠুমরীর তান সন্ধ্যেটা মোহময় করে তুলবে। তবে সেই আশা দুরাশা। ঘর থেকে কিছুই শোনা যায়না। কিন্তু বাথরুম থেকে বেশ স্পষ্ট। তবে বাথরুমে দাঁড়িয়ে শোনাটাও ধৃষ্টতা। আর একই গান বারবার বাজছে। বিরক্তিকরও বটে। কি আর করি – বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। বেশ ঝমঝমিয়ে নেমেছে বৃষ্টিটা এখন। আকাশে বজ্রগর্ভ মেঘের সঞ্চার; ক্ষণবিদ্যুৎ চমকে, সশব্দে, সগর্বে নিজের অস্তিত্ব বোঝাচ্ছে। ঘর থেকে এসবের কিছুই টের পাইনি। মাঝে মাঝে দমকা হাওয়ায় বৃষ্টির ছাঁট এসে গায়ে লাগছে। অতি প্রাচীন সুদৃশ্য রাজবাড়িতে এরকম একটা বর্ষণ্মুখর সন্ধ্যা উপভোগ করতেই তো সকলের বাধা পেরিয়ে এতোদূর ছুটে আসা। সত্যি প্রকৃতিও আমার ওপর স্নেহশীলা। আমার কল্পনাগুলো যেন এক একটা বাস্তব ছবি হয়ে আমার সামনে ফুটে উঠছে।
সূর্যের আলোয় তো বাড়িটা ঘুরে দেখেছি। কিন্তু রাতের আলো আঁধারিতে বাড়িটা একবার ঘুরে দেখলে মন্দ হয়না। প্রকৃতি যেভাবে একের পর এক দৃশ্যপট জুড়ে চলেছেন, তার সাথে যদি আমার উদ্যম খানিকটা মেশে তাহলে একটা ক্লাসিক সিনেমার প্রেক্ষাপট তৈরি হতে আর কতক্ষণ।
আবার ঘুরে দেখতে লাগলাম বাড়ির আনাচ কানাচ। বিকেলের মরা আলোয় যেগুলো দেখেছি ম্রিয়মাণ; সেগুলোই হলদে বাল্বের আলো আর আঁধারিতে বেশ রহস্যময়। গুমোট, স্যাঁতস্যাঁতে আর সোদা গন্ধে ভরপুর এই রাজবাড়ির কোষ্ঠ প্রকোষ্ঠ আমার সমস্ত স্বত্বার ওপর যেন ধীরে ধীরে প্রভাব বিস্তার করছে। আর আমিও যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার কাছে আত্মসমর্পণ করছি। বাড়িটার যেন অনেক গোপন কথা বলার ছিল। মনের মতো কাউকে না পেয়ে এতদিন সব কথা নিজের মধ্যে চেপে রেখে গুমরে মরছে। এবার পেয়েছে আমাকে। যেন আমার পথ চেয়েই এতদিন বসে ছিল। আমাকে সমস্ত কথা বলতে না পারলে যেন আজ আর এর শান্তি নেই। সব জমে থাকা কথা যেন আজ উজাড় করে দিতে চায় আমার কাছে। সমস্ত কিছু দেখাতে চায় আমাকে। আমি নিজের ইচ্ছায় আর ঘুরছিনা এখন। আমি এখন বন্দি একটা অদৃশ্য শক্তির কাছে। তার টানেই চরকির মতো ছুটে বেরাচ্ছি আমি, রাজবাড়ির অলিন্দে অলিন্দে। এতো বারান্দা, এতো সাজানো অন্দরমহল। দীর্ঘদিনের আটকে থাকা ক্রুদ্ধ, লোলুপ, মোহময়, ব্যর্থ বিলাসিতা তো কমল আমায় দেখায়নি। রাজবাড়ির রাজকীয়তার যে অসামান্য প্রতিচ্ছবির সামনে এখন এসে আমি দাঁড়িয়েছি; প্রেতের মতো ঘুরে বেরাচ্ছি এই লুন্ঠিত সম্পদের নির্লজ্জ প্রকাশের মাঝখানে......... কই বিকেল বেলায় তো এই সব কিছুই দেখিনি, এরকম পরিবেশ রক্তে একটা উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে। দুর্ধর্ষ মারাঠা জাতির রক্ত যেন আমার ধমণীতে বইতে শুরু করেছে। কোমরে একটা খাপ সমেত তলোয়ার ঝোলানোর জন্য মনটা আকুলি বিকুলি করছে। আমি এখন আর ধোঁয়া ধূলো মাখা শহরের কেউ নই – নই দুর্বল বাঙ্গালী। আমার হাতের পেশী এখন শক্ত, সবল – তাতে অসুরের শক্তি। পৃথিবীর কোন বাঁধন আর এখন আমায় বেঁধে রাখতে পারবে না। আমার সামনে মাথা তুলে দাঁড়ানোর মতো গুরুপাপে পদাঘাতে মস্তক বিচূর্ণ করাটা নেহাতই লঘুদণ্ড। ঘুরতে ঘুরতে একটা আধ ভেজানো দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। ঘরের ভেতরটা আলোকোজ্জ্বল। দরজার ফাঁক গলে আলো তেরছা ভাবে বাইরে এসে পড়ছে। কার এতো সাহস। আমার সামনে দরজা বন্ধ করে রাখার মতো ধৃষ্টতা দেখায়! সজোরে পদাঘাত করলাম দরজায়। প্রাচীন মজবুত দরজার ফ্রেম মট মট করে উঠল। এই আমিকে আমি চিনিনা।
দরজা ঠেলে ঢুকতেই ভিতরের দৃশ্য বেশ চমকে উঠলাম, নিস্তব্ধ, নির্জন রাজবাড়ির এই কুঠুরী প্রাণের স্পন্দন জ্বেলে রেখেছে। তিনটি প্রাণী চিত্রিত রয়েছে বিলাসী প্রাচীন চিত্রে। তারা যেন বসে ছিল আমারই প্রতীক্ষায়। আমার উদ্যম প্রবেশ এদের অপেক্ষার ঘোর কাটিয়েছে। এরা এখন সচকিত। এই তিনটি প্রাণের একটি প্রাণ সুসজ্জিতা, বহুমূল্য বস্ত্রে বিভুষিতা। গাঢ় প্রসাধনে ইনি সময়ের সমস্ত কলঙ্ক মুছে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কলঙ্ক যে চাঁদের রুপকে তুলনাহীন করে, একথা তিনি বুঝতে না পারায়; অতি সাজগোজ তাঁর স্বাভাবিক লাবণ্যের কন্ঠরোধ করেছে। ইনি বয়সে নবীনা না হলেও গোধূলীবেলার অস্তমিত সুর্যের তেজ এর রূপে। তাঁর উপস্থিতি, দেহবল্লরী সঞ্চালন, দৃষ্টি চপলতা স্পষ্ট করে যে এই সম্প্রদায় রাজাদের জীবনে নৃত্যগীতের অভাব ঘটতে দেয়নি। এঁর দুই পাশের অন্য দুটি প্রাণের একটি তবলা আর অন্যটি সারেঙ্গী। এই ত্রয়ীর মুখোমুখি রাখা একটা সুদৃশ্য লাল মখমলের গদি আঁটা চেয়ার রাখা। নিশ্চয়ই আমার জন্যই হবে। আর এতো ঘুরে ঘুরে আমার পায়ে রীতিমতো ব্যাথা করছে। বসতে আর আপত্তি কিসের। চেয়ারে বসে উপরের দিকে চোখ গেল। রঙ্গিন কাঁচের সুদৃশ্য ঝাড়বাতি ছাদ জুড়ে আলপনা এঁকে রেখেছে। কুটিল, জটিল, অপরূপ তার কারুকাজ। সবথেকে বড় ব্যাপার, এই ঝাড়বাতিটা পুরোপুরি মোমের আলোয় উজ্জ্বল। কোন ইলেকট্রিক বাল্বের ব্যবহার নেই এতে। একটা সীমাহীন অবিশ্বাস, চমক, ভালোলাগা মনকে অবশ করে দিয়েছে। আমার পায়ের নীচে লুটিয়ে থাকা গালিচায় বসে থাকা জীবন্ত অলংকার সম্ভার ঝাড়বাতির আলোয় জ্বলতে শুরু করেছে। সেই আলোর ছটা চোখে জ্বালা ধরায়। সেই মোহময়ী এখন আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন গভীর অনুরাগ নিয়ে। একটা কৌতুক মাখা হাসি মুছে গিয়েও ঠোঁটের এক কোণে আলগা ছাপ রেখে গেছে। চোখে চোখ পরার অপেক্ষা। পড়তেই শুরু হোল গান – “ননদিয়ে কাঁহে মোরে বোল”। সেই গান। যেটা সকাল থেকে আমি অন্তত বিশবার শুনেছি আমার ঘরের বাথরুম থেকে। তখন ভেবেছিলাম রেকর্ড বাজছে। রেকর্ড নয় তাহলে। ইনিই সেই ঠুমরী সম্রাঞ্জী। তাঁর রেওয়াজ শুনেছি তখন তাহলে। কিন্তু এ কেমন রেওয়াজ। বার বার একই গান গেয়ে যাওয়া। এবাড়ির সবই অদ্ভুত। তবে এনার নিপুনতা অবাক করার মতো। প্রত্যেক বার একই রকম, একই ভঙ্গী। ভুল করেও সুরটা কোথাও একচুল সরে যাচ্ছেনা। দম নেওয়া, দম ছাড়াও একদম মাপা। সূক্ষ্ণতম পার্থক্যও নেই। শুনলে সত্যিই মনে হয় রেকর্ড বাজছে। তবলারও প্রত্যেকবার একই ঠেকা; সারেঙ্গীরও একই তান। এই নিয়ে একুশ বার শুনলেও এবারেরটা সবথেকে ভালো লাগছে। অসাধারণ পরিবেশনা, সাবলীল সুর সঞ্চালন। মোহিত করে দেয়। ঠুমরীর পর এবার দাদরা – লয়টা একটু দ্রুত। সারেঙ্গীর ছড়ের টানে বুকটা মুচড়ে মুচড়ে উঠছে। অসাধারণ ভালোলাগা। বর্ষার রাতে রাজবাড়ির রাজসভায় বসে এরকম উৎকৃষ্ট সঙ্গীতের আস্বাদন – সারাজীবনের এক অমূল্য স্মৃতি হয়ে থেকে যাবে এই রাতের রাজা সাজা।
তবে বাঙালীর কান। গান বাজনার কাছাকাছি এলেই রবীন্দ্রসংগীতের জন্য মনটা উতলা হয়ে পড়ে। মুখ ফুটে কিছু বলতে হল না। এবাড়ির সকলেই মন পড়ে ফেলতে পারে। সঙ্গীত সাধিকা আমার মনের ভাব বুঝেই দাদরার পর এবার ধরেছেন একটা টপ্পা, রবীন্দ্রসঙ্গীত। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত যাঁরা চর্চা করেন তাঁদের রবীন্দ্রসঙ্গীতের এই ধারাতেই সাবলীল যাতায়াত। আর আমায় একদম অবাক করে দিয়ে, আমার সবথেকে পছন্দের গানটা এখন তাঁর গলায় – “আমি রূপে তোমায় ভোলাব না”। একরাতে এতো ভালোলাগা যে মানুষ পেতে পারে তা আমার সত্যি জানা ছিলনা। যখন ঠূমরী, দাদরা গাইছিলেন, তখন তাঁর গলাটা ছিল একরকম – ধরা ধরা, মাজা মাজা; টিপিক্যাল ক্লাসিক্যাল। কিন্তু এখন যেন মিষ্টি সুরের ঢল নেমেছে গলায়। চোখ বুজে শুনলে মনে হচ্ছে স্বর্গত কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং এসেছেন গান শোনাতে। একই গলায় এরকম সুরের বৈপরীত্য যে অভাবনীয়। এযে কখনোই হতে পারেনা। সারেঙ্গীতেও এখন এসরাজের সুর। এবার আমার সন্দেহ হচ্ছে। মনের ভেতরের আমিটা যেন বলছে এসব কিছুই সত্যি নয়। বিরাট একটা গোলমাল রয়েছে কোথাও। কোনাভাবেই সুস্থ স্বাভাবিক নয় ব্যপারটা। আমার কান দুটো গরম হয়ে উঠছে। কপালে জমছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। একটা ভীষণ অস্বস্তি সারা শরীর জুড়ে। আমি আর তাকিয়ে থাকতে পারছিনা। জ্বালা করছে চোখগুলো। ঝলমলে পোশাক আমার চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। আপনা আপনিই বুঝে আসছে চোখের পাতা। গানটা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। একদম আমার সামনে এসে তীব্র কোলাহল তুলেছে। মিষ্টি সুরটা এখন যান্ত্রিক, ধাতব লাগছে আমার কাছে। কর্কশ শব্দের তীক্ষ্ণ ছোরা আমূল বিদ্ধ হচ্ছে আমার কানের পর্দায়। আমার হাত দুটোতেও এখন পাষাণভার। চেয়ারের হাতলের সাথে যেন কেউ শক্ত করে বেঁধে রেখেছে। হাত দুটো তুলে কানে চাপা দেওয়ার ক্ষমতাও এখন আর আমার নেই। আমার এতো পছন্দের গানটা যেন এখন আমাকেই খুন করতে উদ্যত। আর এই নিষ্ঠুর বাঈজী আমার চেয়ারের চারিপাশে ঘুরে ঘুরে, পায়ের ভারী নুপুরের তালে তালে, ইনিয়ে বিনিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গেয়ে চলেছে গানটার প্রথম দুটো লাইন। এ যে অসহ্য। আমার কান ভোঁ ভোঁ করছে। আমি আর এই গানটাকে সহ্য করতে পারছিনা। বদ্ধ কালা হয়ে গেলে আমি বাঁচি এখন। ধীরে ধীরে চেতনাও যেন লোপ পাচ্ছে। এখানেই, এই গানের অত্যাচারেই এবার আমি মারা পড়ব।
কিন্তু এভাবে শেষ হয়ে যাবো। এতো সহজে। কিছুতেই না। কিছুতেই না। জলে ডোবা মানুষ যেমন বাঁচার তাগিদে শেষমূহুর্তে আঁকড়ে ধরে তৃণ খণ্ড; তেমনি আমিও সর্বশক্তি দিয়ে শেষ বারের মতো চিৎকার করে উঠলাম – “ আর না। আর না। থামো এবার। আমায় মুক্তি দাও। আমই আর পারছিনা।” এর কতোটা যে গলা দিয়ে বেরোল, আর কতোটা যে আটকে থাকল গলাতেই তা বোঝার মতো শক্তি আর আমার রইলনা। তবে গানটা যেন চকিতে ভয় পেয়ে থমকে গেল। হঠাৎ অন্ধকার হয়ে গেল ঘরটা। নূপুরধ্বনি দ্রুত তালে দূরে ফিকে হয়ে এলো। আর আমার চোখে এসে পড়ল এক ঝাঁক জোড়ালো আলো। আমি তখন প্রায় সংজ্ঞাহীন।
টোটো চলেছে বাজার ছাড়িয়ে। বেশ চওড়া পিচের রাস্তা। বর্ষার অত্যাচারে দু-এক জায়গায় ক্ষত হলেও যথেষ্ট স্বাস্থ্যবতী। রাস্তার দুধারে বড় বড় মূল্যবান সব গাছ রাস্তার ওপর ঘন সবুজ শামিয়ানা টানিয়ে রেখেছে। আর বৃষ্টির জলে ধুয়ে ধুয়ে এই সবুজ শামিয়ানার কোথাও এক ছিঁটে ময়লা নেই। কলকাতার ধোঁয়াটে বর্ষা দেখা চোখ এরকম অমলিন, কোমল, সিক্ত শ্যামলতা দেখে বেশ আরাম পাচ্ছে।
-“স্যার; রাজবাড়িতে কি ঘুরতে?” টোটো চালক ঘাড় ঘুরিয়েছে।
-“ হ্যাঁ ”।
-“ কদিন থাকবেন? ”
-“ কালই চলে যাবো। আজকের রাতটা শুধু। ”
-“ একা একাই এসেছেন? ”
-“ হ্যাঁ – একাই। এই ভরা শ্রাবণে রাজবাড়ি দেখার সঙ্গী আর পেলাম কই!”
-“ হা: হা:। তা ঠিক স্যার। শীত কালে প্রচুর লোক আসে এখানে। এই সময় প্রায় আসেই না বলতে গেলে।”
-“ হুম ”। বিদেশী বিপণনের হাত ধরে এখন যেখানে সেখানে, যখন তখন স্যার ডাকের ছড়াছড়ি।
-“ জানেন স্যার ”; আবার শুরু হল। “এই রাজারা খুব ভালো। এখানকার জন্য অনেক কিছু করেছেন। বাঁদিকে দেখুন স্যার – স্কুল, মেয়েদের। পাশেরটা ছেলেদের। একদম ক্লাস ১২ অবধি। এটা হোস্টেল।” দেখলাম বেশ বড়সড় হস্টেল।ছাত্র সংখ্যা যে খুব খারাপ নয় সেটা বোঝাই যায়। “ এটা কলেজ।” – আমার পথপ্রদর্শকের প্রদর্শন এখনো শেষ হয়নি।“ রাজার নামেই এই কলেজ। ডান দিকে দেখুন হসপিটাল। এই রাজারাই আমাদের এলাকাটাকে আশেপাশের থেকে অনেক উন্নত করে দিয়েছে। কত সিনেমার শুটিং হয় এখানে। রাজবাড়ীতে তো হয়ই।” এরপর শুরু হয়ে গেল সিনেমার লম্বা লিস্ট। অত নাম শোনার ইচ্ছে আর ধৈর্য কোনটাই আমার নেই আপাতত। হ্যাঁ হুঁ করে চললাম।
এতক্ষণে রাজবাড়ীর নাম শুনেই টোটো চালকের ভোল বদলের রহস্যটা আমার সামনে পুরো পরিষ্কার হয়ে গেল। এখানকার লোকেরা তাদের রাজাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। আর রাজারাও আদতে লুঠেরা হলেও কৃতঘ্ন নয়। তারা প্রজাদের ওপর যথেচ্ছ শোষণের প্রতিদান দিতে ভোলেনি। প্রাচীন বর্বরতার কালিমা মুছে রাজারা এখানে সত্যিই প্রজাপরায়ণ।
“ এই যে স্যার এসে গেছি ” – চমক ভাঙল। “ দরকার হলে ডাকবেন স্যার। এই যে কার্ড। আর একটু সাবধানে থাকবেন স্যার। বর্ষার দিনতো।” টাকা নিয়ে, নিজের নাম ছাপা কার্ড আমার হাতে ধরিয়ে টোটোওয়ালা বিদায় নিল।
বৃষ্টিটা একটু ধরেছে। সূর্যও মেঘের ফাঁক দিয়ে আলগোছে উঁকি দিয়ে নিজের অস্তিত্ব বোঝাচ্ছে। একটা জোলো হাওয়া হঠাৎ হঠাৎ করে এসে ভেজা গায়ে শিরশিরাণি তুলছে। আর আমার সামনে এখন এক বাস্তব ইতিহাস। দাঁড়িয়ে আছি ইটাচুনা রাজবাড়ীর সামনে। প্রথমেই একটা ছোট বাগান – সাজানোর চেষ্টা হয়েছিল ঠিকই কিন্তু বর্ষার জলের গুণে আগাছারাই এখন দলে ভারী। বাগানের তিন দিক ঘেরা সুবিশাল অট্টালিকা – সত্যি করেই রাজবাড়ী। বেদানার মতো লাল টকটকে। দোতালা। রাস্তার ঠিক মুখোমুখি কিছুটা অংশ সাদা – তবে শ্বেতপাথরের নয় – চুনকাম করা। এটাই রাজবাড়ীর মুল ফটক। এই ফটকের দুইপাশে দোতালা পর্জন্ত জোড়া থাম উঠে গেছে। তার মাথায় ত্রিভুজাকৃতি তোরণ। গতধরা প্রাচীন ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীর উদাহরণ।
রাস্তা থেকে রাজবাড়ীর সিংহদ্বার অবধি সোজাসুজি কোনো রাস্তা নেই। বাগানকে বাঁয়ে বা ডানে রেখে ঘুরে গিয়ে পৌঁছতে হবে প্রবেশদ্বারে। এই অংশটা রাজবাড়ীর বাহির মহল। এখানেই বাগানের বাঁদিকে রাজবাড়ীর অফিস। বাগানকে ডানে রেখে চলে এলাম সেখানে। খাতায় কলমে রাজবাড়ীর অতিথি হিসাবে নিজেকে নথিভুক্ত করে নিলাম। অফিস ঘরে রাজবাড়ীর একটা ফ্রেম বাঁধানো ছবি ছাড়া আর কিছুই রাজকীয় নয়। মনটা একটু দমে গেল। অফিস ঘর এতো সাদামাটা; ভেতরটা আর কী এমন আহামরী হবে! কিন্তু আমার এই ভাবনাকে থমকে দিয়ে অফিস ঘরে প্রবেশ করেছে এক ঐতিহাসিক চরিত্র। গায়ে ফতুয়া, মালকোচা দেওয়া ধুতি; মাথায় আবার পাগড়ী; আর পায়ে খড়ম। অষ্টাদশ শতকের রাজবাড়ির কর্মচারীরা বোধ হয় এরকমই হত। এই মূর্তিমান ইতিহাস বেশ ঝুঁকে আমায় প্রণাম জানালো এবং আমার ব্যাগটা তুলে নিয়ে এগিয়ে চললো রাজবাড়ীর মূল ফটকের দিকে। আমিও তাকে অনুসরণ করলাম।
অফিস ঘরের সাদামাটা অবস্থা দেখে আমার মনে যে দুশ্চিন্তার চোরাস্রোত বইতে শুরু করেছিলো তা পুরোপুরি চাপা পড়ে গেল মূল রাজবাড়ীর ভেতর ঢুকে। মূল ফটক পেরিয়েই এসে পড়লাম লাল সিমেন্ট বাঁধানো একটা বিরাট চৌকো চাতালে। এর ঠিক মাঝখানে সাদা আলপনা; বৃষ্টির জলে ধুয়ে ধুয়েও এখনও সবটা মুছে যায়নি। সারি সারি নকশাওয়ালা কালো কালো বাতিস্তম্ভ সারা চাতালে ছড়ানো। এই চত্বরটা এতোটাই বড়ো যে এখানে একটা ছোট হাউসিং কমপ্লেক্স তৈরি হতে পারে। এই চত্বরকে ঘিরে রেখেছে দ্বিতল রাজবাড়ী। দোতালায় রেলিং দেওয়া বারান্দা আর টানা ঘর। একতলার বারান্দা গুলো রেলিং ছাড়া। একতলাতেও দোতলার মতো ঘরের সারি। সব ঘরই বন্ধ। মূল ফটকের ঠিক অপরপ্রান্তে চাতালের শেষে অবস্থান করছে এক বিরাট মন্দির। নিঃসন্দেহে রাজাদের গৃহদেবতা। আমার পথপ্রদর্শককে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল এই মন্দিরে রাধা-কৃষ্ণের অধিষ্ঠান। পথপ্রদর্শকের নামটাও এর মধ্যে জেনে ফেলেছি – কমল।রাজকর্মচারীদের মতই গাম্ভীর্য আর প্রশ্নের উত্তরে বেশী শব্দের ব্যাবহার এর নীতিবিরদ্ধ। কমল এখন আমাকে আর মন্দিরের দিকে না নিয়ে গিয়ে ডানদিকের একটা ছোট দরজা দিয়ে নিয়ে এলো একদম অন্দরমহলে। এই অন্দরমহলের মাঝখানেও সিমেন্ট বাঁধানো উঠোন। তবে এটা অনেক ছোট। বাইরের চাতালের এক চতুর্থাংশ। এই উঠোনের চারপাশ দিয়ে ঘর। বাড়িটা দোতালা।
এরকম তিনমহলা বাড়ি দেখার অভিজ্ঞতা আমার প্রথম। ভাবতে অবাক লাগে এতো বড়ো বাড়ি নিশ্চয়ই রাজাদের রাজত্বকালে কোলাহল মুখরিত ছিল। কতো হাসি-কান্না, রাগ-অভিমান, হিংসা-ভালোবাসার স্মৃতি জড়িয়ে আছে এর মোটা মোটা লাল দেওয়ালের আনাচে কানাচে। আজ সব ফাঁকা, শুনশান, নিঃশব্দ; লোকজনেরও দেখা নেই। এতো বড়ো রাজবাড়ীতে এখনও পর্যন্ত মাত্র দুজন মানুষকে দেখলাম। এক ঐ অফিসের অফিসবাবু আর দুই আমার পথপ্রদর্শক কমল। আমাকে চাতালে এনে দাঁড় করিয়ে রেখে সেও কোন গোপন কুঠুরীতে আত্মগোপন করেছে।
এই চতুর্ভুজ একতলাটার দুই বাহুতে থাকার ঘর। আর অবশিষ্ট দুই বাহুর একটা মনে হয় রান্নাঘর আর অন্যটায় খাবার ঘর। রান্নাঘর আর খাবার ঘরে একাধিক দরজা। তার একটা দিয়ে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল কমলকে। হাতে একটা পাত্র। অত্যন্ত পুরানো। এখনকার দিনে ওরকম পাত্র দেখাই যায়না। তাই নাম জানারও প্রশ্নই ওঠেনা।
“ স্যার, পা ধোয়ার জল এনিচি; পা টা ধুয়ে নিন।”
কানে কট্ করে লাগলো কথাটা। বেশ একটা পুরোনো সময়ে চলে গেছিলাম। ‘স্যার’ কথাটা যেন টাইম মেশিনের হ্যান্ডেলটাকে এক ঝটকায় ঘুরিয়ে একবিংশ শতকে ফিরিয়ে আনল। বড্ড বেমানান।
পা ধুয়ে প্রবেশ করলাম অন্দরমহলের অন্দরে। পরিপাটি করে সাজানো বসার ঘর। উপর থেকে ঝুলছে চাইনিজ ঝাড়বাতি। বসার জন্য রাজকীয় সোফা – নতুন করে তাতে পালিশ পরেছে। সোফার নরম গদিতে শরীর ছেড়ে দিতে না দিতেই পোশাকে প্রাচীন বয়সে নবীন এক চরিত্রের প্রবেশ। আমার দেখা রাজবাড়ীর লোক সংখ্যা দুই থেকে তিন হলো এবার। এর হাতে পিতলের রেকাব – তার উপর বসানো পিতলের পানপাত্র। অতিথিকে আপ্যায়ন জানানোর রাজকীয় প্রথা। রাজবাড়ির সুদৃশ্য পানপাত্র শুনে হয়তো পাঠকের প্রত্যাশাটা একটা অন্য খাতে বইতে শুরু করতে পারে। কিন্তু এই পানপাত্র নুন-লেবু-চিনির অতি পরিচিত সরবতেই পরিপূর্ণ। অন্যরকম পানীয়ের কল্পনা সম্পূর্ণই অমূলক।
আমার জন্য নির্ধারিত হয়েছে ‘ছোট পিসির’ ঘর। কমলের মুখে কথাটা শুনে অবাকই হলাম। ছোট পিসি আমার ওপর দয়াপরবশ হয়ে আজকের রাতটা নিজের ঘর ছেড়ে দিয়েছেন, না কি? না তা নয়। কমল আমাকে আশ্বস্ত করল ওটা নামেই ছোট পিসির ঘর। কিন্তু রাজাদের এই ছোট পিসি কোথায় থাকেন বা আদতে আছেন কিনা সে প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ অবান্তর। এখানকার সব অতিথি আপ্যায়ণের ঘরের নামের সঙ্গেই এবাড়ির বাসিন্দাদের – ‘ বড় বৌদি’, ‘ ছোড়দা’, ‘ঠাকুমা’ নিত্য যোগাযোগ।
কমলের সাথে উঠে এলাম দোতলায়। সিঁড়িটা এসে শেষ হয়েছে চতুর্কোণ দোতলার এক কোণে। এর দুই দিকে দুই বাহু। আমরা ডানদিকের বাহু দিয়ে এগোলাম। লম্বা করিডর। তার ডানপাশে ঘর আর বাঁপাশে বারান্দা। করিডোরে সুসজ্জিত বিলাস বহুল সোফা পাতা। একেকটা একেক রকম। অপূর্ব কারুকাজ। অঙ্গসজ্জায় একে অপরকে প্রাণপণ টেক্কা দেওয়ার চেষ্টা করছে। এতো রকমের বসার আসবাব যে হয় তা আমার ধারণার বাইরে ছিল। বসার থেকে এগুলো দেখেই বেশী আনন্দ পাওয়া যায়। করিডরের বারান্দার দিকের জানালায় রঙ্গিন কাঁচ। সেইসব কাঁচ ভেদ করে আসা রঙিন আলো জায়গাটাকে মায়াবী করে রেখেছে। করিডর এর বারান্দার দিকের দরজা দিয়ে এসে দাঁড়ালাম রেলিং ঘেরা বারান্দায়। রেলিং ধরে ঝুঁকলে নিচের উঠোন দেখা যায়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলাম চতুর্ভুজ দোতলার তিন ভুজের নকশা একই রকম। এই তিন দিক জুড়েই পরপর বারান্দা, করিডর আর ঘর। আর আমার ডানপাশে, দোতলার একদিক জুড়ে খোলা ছাদ। বারান্দা দিয়ে চলে এলাম খোলা ছাদে। বৃষ্টির জলে জায়গাটা পিছল। আর এখানে ভিড় জমিয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির অর্কিড। তাদের কোনটাতে আবার ফুল ফুটেছে। ছাদ পেরিয়ে আবার একই রকম বারান্দা, করিডর, ঘর। দোতালাটা পুরোটাই সংযুক্ত। পুরোটা চক্কর দিয়ে আবার প্রথম দেখা করিডোরেই ফিরে এলাম। এখানে পর পর তিনটে ঘরের মধ্যে দুটি বন্ধ আর মাঝেরটা খোলা। দরজায় ভারী পর্দা ঝুলছে। দরজার পাশের দেওয়ালে কায়দা করে লেখা ‘ছোট পিসির ঘর’। তাহলে এই ঘরটাই আজকে রাতে আমার ঠিকানা।
পা দিলাম ঘরের ভেতরে। সিনেমায় দেখা রাজবাড়ীর সাথে হুবহু মিল। মোটা মোটা দেওয়াল। হলদেটে আলোয় ঘরটা মাখামাখি হয়ে আছে। অদ্ভুত রকমের ঠাণ্ডা মেঝে। মার্বেল পাথরের। সাদা কালো ছক মেলানো। ঘরটা পেল্লায় রকমের বড়। শপিং মলের ফুড কোর্ট এর মধ্যে সহজেই ঢুকে যেতে পারে। প্রায় আড়াই মানুষ সমান উঁচু সিলিং। ওপর থেকে নেমে আসা রড থেকে ঝুলে ঘুরছে ইলেকট্রিক ফ্যান। হাতে টানা পাখার বন্দোবস্ত থাকলেও তা নেহাতই স্মৃতিচিহ্ন। ঘরের ডানদিকটা পুরোটা জুড়ে রয়েছে একটা পালঙ্ক – সত্যি পালঙ্ক বলতে মনের মধ্যে এরকমই ছবি ফুটে ওঠে। চকচকে কালো মেহগনী পালিশ। অপূর্ব তার কারুকাজ। এর অঙ্গ জুড়ে জড়িয়ে থাকা ব্রীড়া, তনু বিভঙ্গ মনকে মুগ্ধ করে। আর এটা এতোটাই বড় যে এতে তিন-চার জন লোক অনায়াসে শুতে পারে। এই পালঙ্কের সাথের দেওয়াল জুড়ে দেওয়াল আলমারি। এই আলমারীর পালিশ এবং কারুকাজে পালঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। ঘরের বাঁদিকে ড্রেসিং টেবিল, লেখার টেবিল, ওয়ারড্রব দেওয়াল ঘেঁসে পাশাপাশি রাখা। এরাও যথেষ্ট সুন্দরী এবং ঘরের মানানসই। ঘরের মাঝখানে পাতা কার্পেট। তাকে ঘিরে গদি আঁটা সুদৃশ্য চেয়ার সাজিয়ে বসার জায়গা করা রয়েছে। প্রত্যেকটা আসবাবই বেশ পুরনো কিন্তু তাদের গা দিয়ে এখনও আলো পিছলে যায়। অর্থাৎ নিঃসন্দেহে এরা সযত্নে লালিত। দেওয়ালে ঝুলছে একটা ওয়েল পেন্টিং। এক মহিলার। রাজাদেরই কেউ হবেন হয়তো। হয়তবা ‘ছোটপিসির’ যৌবনই এখানে ফ্রেম বন্দি। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন একটা থামের গায়ে হেলান দিয়ে। শিল্পের দিক থেকে এই ছবি খুব উঁচূ মানের না হলেও এটা নিঃসন্দেহে ঘরের আভিজাত্য কয়েকগুণ বাড়িয়ে তুলেছে।
ঘরেরই একটা চেয়ারে বসলাম বেশ আরাম করে। এই সময় একটু চা যদি পেতাম, মন্দ হতনা। কিন্তু বলবই বা কাকে। কমলতো ঘর গুছিয়েই বেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। এরকম একটা বিলাসবহুল সেকেলে জমিদার বাড়িতে বসে মনটা বেশ অন্যরকম হয়ে গেছে। এই অনুভুতিটার জন্যইতো এতো কষ্ট করে বৃষ্টি মাথায় করে এখানে আসা। আশা করি দিনটা যাবে না, বেশ ভালোই কাটবে। “আপনার চা” – কমলের ডাকে ঘর ভাঙল। এক্ষুনি ভাবছিলাম চায়ের কথা, আর চা নিয়ে হাজির। মন পড়তে পারে নাকি! যখন যা চাইব বলে ভাবছি সেটা নিয়েই হাজির হয়ে যাচ্ছে। এই লোকটা বেশ অবাক করছে। একে কথা তো প্রায় বলেই না। তার ওপর আদ্যিকালের পোশাকে মোড়া রোগাটে ক্ষয়াটে চেহারা। দেখে মনে হয় যেন রাজবাড়ির প্রথমদিন থেকেই এই লোক একই ভাবে নীরবে কাজ করে চলেছে। এ যেন জন্ম মৃত্যুর ঊর্ধে। রাজবাড়িতে এর উপস্থিতি যেন কেউ টলাতে পারেনি। শুধু রাজবাড়ির এই দুর্দিনে এর মুখে পড়েছে একটা মলিন ছায়া। বর্ষামুখর দিনে পুরনো রাজবাড়িতে এরকম একটা চরিত্রের উপস্থিতি বেশ উপভোগ্য গা ছমছমে ভাবের সঞ্চার করেছে।
চা টা শেষ করে স্নানের তোড়জোড় শুরু করলাম। ১২ টা বেজে গেছে এর মধ্যেই। ঘরের সাথেই বাথরুম। কাঠের মোটা পাল্লার দরজা। ঢুকলাম ভেতরে। এর যা সাইজ তাতে করে এতে ছোট ফ্ল্যাটের একটা বেডরুম অথবা বড়ো ফ্ল্যাটের একটা গেস্টরুম বানানোই যায়। কিন্তু রাজবাড়ি বলে কথা। তার বাথরুমটাও তো রাজকীয় হওয়া চাই। তবে এর অঙ্গসজ্জায় কোন প্রাচীনতা নেই। পুরোটাই আধুনিক ব্যাবস্থা। প্যাচপ্যাচে ঘাম আর বৃষ্টি ভেজা শরীর কৃত্রিম বৃষ্টিধারায় পেতে দিলাম – আহঃ! কী আরাম। কানে ভেসে আসছে সুরেলা মার্জিত কন্ঠের উৎকৃষ্ট ঠুমরী – ‘ননদিয়া কাঁহে মোরে বোল’। বেশ পুরনো দিনের মার্জনা। রেকর্ড বাজছে কোথাও হয়ত। ঘর থেকে শোনা যায়নি কিন্তু বাথরুম থেকে বেশ স্পষ্ট।
ফিটফাট হয়ে বসতে না বসতেই দরজায় টক টক। যথারীতি কমল। “আসুন। ভাত বেড়িচি।” একতলা খাবার ঘরে এলাম। সাবেকি আমলের চেয়ার টেবিল, জল ঢাকা কাঁসার গ্লাসে। খাবারও এল কাঁসার থালা বাটিতে রাজবাড়ির সম্মান বজায় রেখে। বাটি ভাত। তার পাশে কাত করে রাখা দুটো লুচি। থালার আশ পাশ দিয়ে সাজানো হতে লাগলো ষোড়শ উপাচার। পাতে পড়ল ঘি। তারপর শুক্তোয় মুখ তিতো করে সুগন্ধি মুগডালে গলা ভিজিয়ে, আরো সব ব্যঞ্জন সামলে যখন মাংসের বাটির দিকে হাত বাড়ালাম ততক্ষণে পেট ভরেই গেছে প্রায়। অবশ্য বাদ প্রায় কিছুই দিলাম না। দই মিষ্টি পর্্যন্ত চেটেপুটে খেয়ে নিলাম। রাজবাড়ির রাজকীয় ভোজ – অতুলনীয়। ঝিরঝিরে বৃষ্টিটাও আবার শুরু হয়েছে। ভেজা ভেজা ঠান্ডা ঠান্ডা আমেজ। ‘ছোটপিসি’র পালঙ্কটা যেন ডাকছে। কমল বলেছে বিকেলে পুরো বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখাবে। এখনও তার অনেক দেরী। অতএব ছোট করে একটা ভাত ঘুম সেরে নেওয়াই যায়।
বিকেলে বৃষ্টিটা আর নেই। সারাদিন মুখ লুকিয়ে থেকে দিনমণি শেষ বেলায় আশ মিটিয়ে পৃথিবীটাকে দেখে নিচ্ছেন। একটা লালচে হলদে আলো চারিপাশে। ভেজা মাটি থেকে ভাপ উঠে চারিপাশ ধোঁয়া ধোঁয়া। কমলের সাথে ঘুরে বেরাচ্ছি বাড়ির আনাচ কানাচ। রাজবাড়ির বাইরের অংশে পূজা মন্ডপ, ক্ষেত, পুকুর সবই আছে। বাড়ির ভেতরের অংশেও প্রচুর ঘর, বারান্দা – বিভিন্ন রকমের, বিভিন্ন ধরনের। স্পষ্টতই সুন্দর এবং প্রাচীনত্বের ছোঁয়ায় ভরপুর। তবে চোখে পরার মতো হলো একটা দাবার বোর্ড – বরং বলা ভালো দাবার টেবিল। টেবিল জোড়া দাবার ছক। সাদা কালো মার্বেল পাথরের ছক কাটা। অসম্ভব রকমের সুন্দর। আর এতোটাই বড় যে এর এক প্রান্তে বসে আরেক প্রান্ত ছুঁতেই পারা যায়না। গুটিগুলোও মার্বেলের। প্রায় এক ফুট করে লম্বা। আর ছক মেলানো মার্বেলের বারান্দার শেষ প্রান্তে পেতে রাখা এই দাবার ছক একে অপরের সৌন্দর্যকে দ্বিগুণ করেছে। স্মার্টফোন স্ক্রিনে বাঁধা দাবার ছক দেখা চোখ এই বিশালত্বের সামনে হতবাক হতে বাধ্য। এই বারান্দার অপর প্রান্তে ছাদে ওঠার সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে ছাদে। ছাদটা নিঃসন্দেহে বিরাট। রাজবাড়ির তিনটে মহল জোড়া ছাদ। পুরোটা ঘুরে আসতে হলে পায়ের বেশ ধকল সইতে হবে। এই ছাদে আগে কখনও না এলেও মনে হয় যেন খুব চেনা। বুক সমান উঁচু পাচিল; ছোট ছোট করে ভাগ করা। বহু সিনেমায় এরকম ছাদই ঘটনার ঘনঘটায় ঘনঘোর হয়ে ওঠে। ছাদের আলসেতে ভর করে দূরে তাকালে দৃষ্টি দিগন্ত ছুঁয়ে আসে। ক্ষেতের ধারে একটা বড় ফুলে ফুলে হলদে হয়ে থাকা রাধাচুঁড়া গাছের মাথায় আগুন জ্বালিয়ে আজকের মত পথ চলা শেষ করল ক্লান্ত, সিক্ত সূর্য। শাঁখ বেজে উঠল – বোধ হয় নিচের রাধা গোবিন্দ মন্দিরে। “চলুন এবার নিচে যাই। আরতি শুরু হবে মন্দিরে” – অনেকক্ষণ বাদে কমল মুখ খুলেছে।
মন্দিরে অলঙ্কার বিভূষিত, ফুলমালা শোভিত, চন্দন চর্চিত, সুসজ্জিত রাধাকৃষ্ণ পরষ্পরের আলিঙ্গনাবদ্ধ। বয়স্ক পুরোহিত ভক্তিতে অবিচল এবং যত্ন পরায়ণ। কাঁসর সহযোগে আরতি বেশ জমে উঠেছে। আমার উপস্থিতি নিশ্চয়ই পুরোহিত মহাশয়ের উৎসাহ কিছুটা বাড়িয়ে তুলেছে। কারণ এখানে আমিই একমাত্র বহিরাগত এবং আতিথি। সকাল থেকে এবাড়িতে এসে আমায় সব থেকে অবাক করেছে এর নির্জনতা। লোক প্রায় নেই। কাউকে দেখাই যায়না। এখনও অবধি আমি ঠাকুর মশাই কে নিয়ে হাতে গুনে চার জনকে দেখেছি। তাও যেন যন্ত্রচালিত পুতুল। হঠাৎ হঠাৎ করে মাটি ফুঁড়ে সামনে হাজির হয়। তারপর নিজের কাজটা করেই আবার অদৃশ্য হয়ে যায়। কোন কথা নেই মুখে। এক কমল আর দুই অফিস বাবু ছাড়া আর কাউর মুখে আমি কোন কথা শুনিনি। কোন গোপন মন্ত্রের আবেশে আবিষ্ট কিছু লোক যেন ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে এসে দীর্ঘ দিন ধরে একই ভাবে, একই লয়ে, একই ছন্দে, একই রকম কাজ করে চলেছে। সুদূর অতীত থেকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতেও কোন রকম বদল না ঘটেই যেন চলতে থাকবে এই জীবন্ত প্রাচীনতা – অপার স্তব্ধতা।
চা ঘরটা বেশ সুন্দর। ছাতিম তলায়। খড়ের ছাউনি। মাটির দাওয়া। সুদৃশ্য চিনামাটির কাপ প্লেটে চা – গ্রীন টী। বিলাসিতার পালিশে কথাও ধুলো জমার সুযোগ নেই। মন্দিরের আরতি শেষ অবধি দেখার মতো ধৈর্য আর আমার ছিলনা। পিপাসার্ত হয়ে পড়েছিলাম। কমল যথারীতি আমার মন পড়ে ফেলে চা-ঘরে নিয়ে এসেছে। আমায় চা বানিয়ে দিয়ে নিজে এখন একটা দেওয়ালের আড়ালে ধোঁয়া বিলাস করে নিচ্ছে। নিজের শরীরটা লুকিয়ে ফেলেছে ঠিকই কিন্তু ধোঁয়া আর কি করে লুকোবে। দেওয়ালের পিছন থেকে ফুর ফুর করে ধোঁয়া উঠছে।
চা শেষ করে পায়ে পায়ে ঘরে এলাম। এত বড় বাড়ি; এত বড় ঘর; নিস্তব্ধতা; নির্জনতা বেশ একটা আবেশ তৈরী করেছে মনের ওপর। বাথরুমে ঘুরে এলাম। এখনও রেকর্ড বাজছে শোনা যাচ্ছে। আর একই গান। একই গান এতো বার কেউ শোনে? সে যতই ভালো গান হোক। কী জানি কি ব্যাপার? বাথরমের দরজাটা একটু খুলে রাখলাম। যদি ঘর থেকে শোনা যায় গানটা। তাহলে এই নিশ্ছিদ্র নির্জনতায়, বর্ষণমুখরতায়, রাজবাড়ির এক রাজকীয় ঘরে বসে দূর থেকে ভেসে আসা ঠুমরীর তান সন্ধ্যেটা মোহময় করে তুলবে। তবে সেই আশা দুরাশা। ঘর থেকে কিছুই শোনা যায়না। কিন্তু বাথরুম থেকে বেশ স্পষ্ট। তবে বাথরুমে দাঁড়িয়ে শোনাটাও ধৃষ্টতা। আর একই গান বারবার বাজছে। বিরক্তিকরও বটে। কি আর করি – বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। বেশ ঝমঝমিয়ে নেমেছে বৃষ্টিটা এখন। আকাশে বজ্রগর্ভ মেঘের সঞ্চার; ক্ষণবিদ্যুৎ চমকে, সশব্দে, সগর্বে নিজের অস্তিত্ব বোঝাচ্ছে। ঘর থেকে এসবের কিছুই টের পাইনি। মাঝে মাঝে দমকা হাওয়ায় বৃষ্টির ছাঁট এসে গায়ে লাগছে। অতি প্রাচীন সুদৃশ্য রাজবাড়িতে এরকম একটা বর্ষণ্মুখর সন্ধ্যা উপভোগ করতেই তো সকলের বাধা পেরিয়ে এতোদূর ছুটে আসা। সত্যি প্রকৃতিও আমার ওপর স্নেহশীলা। আমার কল্পনাগুলো যেন এক একটা বাস্তব ছবি হয়ে আমার সামনে ফুটে উঠছে।
সূর্যের আলোয় তো বাড়িটা ঘুরে দেখেছি। কিন্তু রাতের আলো আঁধারিতে বাড়িটা একবার ঘুরে দেখলে মন্দ হয়না। প্রকৃতি যেভাবে একের পর এক দৃশ্যপট জুড়ে চলেছেন, তার সাথে যদি আমার উদ্যম খানিকটা মেশে তাহলে একটা ক্লাসিক সিনেমার প্রেক্ষাপট তৈরি হতে আর কতক্ষণ।
আবার ঘুরে দেখতে লাগলাম বাড়ির আনাচ কানাচ। বিকেলের মরা আলোয় যেগুলো দেখেছি ম্রিয়মাণ; সেগুলোই হলদে বাল্বের আলো আর আঁধারিতে বেশ রহস্যময়। গুমোট, স্যাঁতস্যাঁতে আর সোদা গন্ধে ভরপুর এই রাজবাড়ির কোষ্ঠ প্রকোষ্ঠ আমার সমস্ত স্বত্বার ওপর যেন ধীরে ধীরে প্রভাব বিস্তার করছে। আর আমিও যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার কাছে আত্মসমর্পণ করছি। বাড়িটার যেন অনেক গোপন কথা বলার ছিল। মনের মতো কাউকে না পেয়ে এতদিন সব কথা নিজের মধ্যে চেপে রেখে গুমরে মরছে। এবার পেয়েছে আমাকে। যেন আমার পথ চেয়েই এতদিন বসে ছিল। আমাকে সমস্ত কথা বলতে না পারলে যেন আজ আর এর শান্তি নেই। সব জমে থাকা কথা যেন আজ উজাড় করে দিতে চায় আমার কাছে। সমস্ত কিছু দেখাতে চায় আমাকে। আমি নিজের ইচ্ছায় আর ঘুরছিনা এখন। আমি এখন বন্দি একটা অদৃশ্য শক্তির কাছে। তার টানেই চরকির মতো ছুটে বেরাচ্ছি আমি, রাজবাড়ির অলিন্দে অলিন্দে। এতো বারান্দা, এতো সাজানো অন্দরমহল। দীর্ঘদিনের আটকে থাকা ক্রুদ্ধ, লোলুপ, মোহময়, ব্যর্থ বিলাসিতা তো কমল আমায় দেখায়নি। রাজবাড়ির রাজকীয়তার যে অসামান্য প্রতিচ্ছবির সামনে এখন এসে আমি দাঁড়িয়েছি; প্রেতের মতো ঘুরে বেরাচ্ছি এই লুন্ঠিত সম্পদের নির্লজ্জ প্রকাশের মাঝখানে......... কই বিকেল বেলায় তো এই সব কিছুই দেখিনি, এরকম পরিবেশ রক্তে একটা উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে। দুর্ধর্ষ মারাঠা জাতির রক্ত যেন আমার ধমণীতে বইতে শুরু করেছে। কোমরে একটা খাপ সমেত তলোয়ার ঝোলানোর জন্য মনটা আকুলি বিকুলি করছে। আমি এখন আর ধোঁয়া ধূলো মাখা শহরের কেউ নই – নই দুর্বল বাঙ্গালী। আমার হাতের পেশী এখন শক্ত, সবল – তাতে অসুরের শক্তি। পৃথিবীর কোন বাঁধন আর এখন আমায় বেঁধে রাখতে পারবে না। আমার সামনে মাথা তুলে দাঁড়ানোর মতো গুরুপাপে পদাঘাতে মস্তক বিচূর্ণ করাটা নেহাতই লঘুদণ্ড। ঘুরতে ঘুরতে একটা আধ ভেজানো দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। ঘরের ভেতরটা আলোকোজ্জ্বল। দরজার ফাঁক গলে আলো তেরছা ভাবে বাইরে এসে পড়ছে। কার এতো সাহস। আমার সামনে দরজা বন্ধ করে রাখার মতো ধৃষ্টতা দেখায়! সজোরে পদাঘাত করলাম দরজায়। প্রাচীন মজবুত দরজার ফ্রেম মট মট করে উঠল। এই আমিকে আমি চিনিনা।
দরজা ঠেলে ঢুকতেই ভিতরের দৃশ্য বেশ চমকে উঠলাম, নিস্তব্ধ, নির্জন রাজবাড়ির এই কুঠুরী প্রাণের স্পন্দন জ্বেলে রেখেছে। তিনটি প্রাণী চিত্রিত রয়েছে বিলাসী প্রাচীন চিত্রে। তারা যেন বসে ছিল আমারই প্রতীক্ষায়। আমার উদ্যম প্রবেশ এদের অপেক্ষার ঘোর কাটিয়েছে। এরা এখন সচকিত। এই তিনটি প্রাণের একটি প্রাণ সুসজ্জিতা, বহুমূল্য বস্ত্রে বিভুষিতা। গাঢ় প্রসাধনে ইনি সময়ের সমস্ত কলঙ্ক মুছে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কলঙ্ক যে চাঁদের রুপকে তুলনাহীন করে, একথা তিনি বুঝতে না পারায়; অতি সাজগোজ তাঁর স্বাভাবিক লাবণ্যের কন্ঠরোধ করেছে। ইনি বয়সে নবীনা না হলেও গোধূলীবেলার অস্তমিত সুর্যের তেজ এর রূপে। তাঁর উপস্থিতি, দেহবল্লরী সঞ্চালন, দৃষ্টি চপলতা স্পষ্ট করে যে এই সম্প্রদায় রাজাদের জীবনে নৃত্যগীতের অভাব ঘটতে দেয়নি। এঁর দুই পাশের অন্য দুটি প্রাণের একটি তবলা আর অন্যটি সারেঙ্গী। এই ত্রয়ীর মুখোমুখি রাখা একটা সুদৃশ্য লাল মখমলের গদি আঁটা চেয়ার রাখা। নিশ্চয়ই আমার জন্যই হবে। আর এতো ঘুরে ঘুরে আমার পায়ে রীতিমতো ব্যাথা করছে। বসতে আর আপত্তি কিসের। চেয়ারে বসে উপরের দিকে চোখ গেল। রঙ্গিন কাঁচের সুদৃশ্য ঝাড়বাতি ছাদ জুড়ে আলপনা এঁকে রেখেছে। কুটিল, জটিল, অপরূপ তার কারুকাজ। সবথেকে বড় ব্যাপার, এই ঝাড়বাতিটা পুরোপুরি মোমের আলোয় উজ্জ্বল। কোন ইলেকট্রিক বাল্বের ব্যবহার নেই এতে। একটা সীমাহীন অবিশ্বাস, চমক, ভালোলাগা মনকে অবশ করে দিয়েছে। আমার পায়ের নীচে লুটিয়ে থাকা গালিচায় বসে থাকা জীবন্ত অলংকার সম্ভার ঝাড়বাতির আলোয় জ্বলতে শুরু করেছে। সেই আলোর ছটা চোখে জ্বালা ধরায়। সেই মোহময়ী এখন আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন গভীর অনুরাগ নিয়ে। একটা কৌতুক মাখা হাসি মুছে গিয়েও ঠোঁটের এক কোণে আলগা ছাপ রেখে গেছে। চোখে চোখ পরার অপেক্ষা। পড়তেই শুরু হোল গান – “ননদিয়ে কাঁহে মোরে বোল”। সেই গান। যেটা সকাল থেকে আমি অন্তত বিশবার শুনেছি আমার ঘরের বাথরুম থেকে। তখন ভেবেছিলাম রেকর্ড বাজছে। রেকর্ড নয় তাহলে। ইনিই সেই ঠুমরী সম্রাঞ্জী। তাঁর রেওয়াজ শুনেছি তখন তাহলে। কিন্তু এ কেমন রেওয়াজ। বার বার একই গান গেয়ে যাওয়া। এবাড়ির সবই অদ্ভুত। তবে এনার নিপুনতা অবাক করার মতো। প্রত্যেক বার একই রকম, একই ভঙ্গী। ভুল করেও সুরটা কোথাও একচুল সরে যাচ্ছেনা। দম নেওয়া, দম ছাড়াও একদম মাপা। সূক্ষ্ণতম পার্থক্যও নেই। শুনলে সত্যিই মনে হয় রেকর্ড বাজছে। তবলারও প্রত্যেকবার একই ঠেকা; সারেঙ্গীরও একই তান। এই নিয়ে একুশ বার শুনলেও এবারেরটা সবথেকে ভালো লাগছে। অসাধারণ পরিবেশনা, সাবলীল সুর সঞ্চালন। মোহিত করে দেয়। ঠুমরীর পর এবার দাদরা – লয়টা একটু দ্রুত। সারেঙ্গীর ছড়ের টানে বুকটা মুচড়ে মুচড়ে উঠছে। অসাধারণ ভালোলাগা। বর্ষার রাতে রাজবাড়ির রাজসভায় বসে এরকম উৎকৃষ্ট সঙ্গীতের আস্বাদন – সারাজীবনের এক অমূল্য স্মৃতি হয়ে থেকে যাবে এই রাতের রাজা সাজা।
তবে বাঙালীর কান। গান বাজনার কাছাকাছি এলেই রবীন্দ্রসংগীতের জন্য মনটা উতলা হয়ে পড়ে। মুখ ফুটে কিছু বলতে হল না। এবাড়ির সকলেই মন পড়ে ফেলতে পারে। সঙ্গীত সাধিকা আমার মনের ভাব বুঝেই দাদরার পর এবার ধরেছেন একটা টপ্পা, রবীন্দ্রসঙ্গীত। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত যাঁরা চর্চা করেন তাঁদের রবীন্দ্রসঙ্গীতের এই ধারাতেই সাবলীল যাতায়াত। আর আমায় একদম অবাক করে দিয়ে, আমার সবথেকে পছন্দের গানটা এখন তাঁর গলায় – “আমি রূপে তোমায় ভোলাব না”। একরাতে এতো ভালোলাগা যে মানুষ পেতে পারে তা আমার সত্যি জানা ছিলনা। যখন ঠূমরী, দাদরা গাইছিলেন, তখন তাঁর গলাটা ছিল একরকম – ধরা ধরা, মাজা মাজা; টিপিক্যাল ক্লাসিক্যাল। কিন্তু এখন যেন মিষ্টি সুরের ঢল নেমেছে গলায়। চোখ বুজে শুনলে মনে হচ্ছে স্বর্গত কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং এসেছেন গান শোনাতে। একই গলায় এরকম সুরের বৈপরীত্য যে অভাবনীয়। এযে কখনোই হতে পারেনা। সারেঙ্গীতেও এখন এসরাজের সুর। এবার আমার সন্দেহ হচ্ছে। মনের ভেতরের আমিটা যেন বলছে এসব কিছুই সত্যি নয়। বিরাট একটা গোলমাল রয়েছে কোথাও। কোনাভাবেই সুস্থ স্বাভাবিক নয় ব্যপারটা। আমার কান দুটো গরম হয়ে উঠছে। কপালে জমছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। একটা ভীষণ অস্বস্তি সারা শরীর জুড়ে। আমি আর তাকিয়ে থাকতে পারছিনা। জ্বালা করছে চোখগুলো। ঝলমলে পোশাক আমার চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। আপনা আপনিই বুঝে আসছে চোখের পাতা। গানটা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। একদম আমার সামনে এসে তীব্র কোলাহল তুলেছে। মিষ্টি সুরটা এখন যান্ত্রিক, ধাতব লাগছে আমার কাছে। কর্কশ শব্দের তীক্ষ্ণ ছোরা আমূল বিদ্ধ হচ্ছে আমার কানের পর্দায়। আমার হাত দুটোতেও এখন পাষাণভার। চেয়ারের হাতলের সাথে যেন কেউ শক্ত করে বেঁধে রেখেছে। হাত দুটো তুলে কানে চাপা দেওয়ার ক্ষমতাও এখন আর আমার নেই। আমার এতো পছন্দের গানটা যেন এখন আমাকেই খুন করতে উদ্যত। আর এই নিষ্ঠুর বাঈজী আমার চেয়ারের চারিপাশে ঘুরে ঘুরে, পায়ের ভারী নুপুরের তালে তালে, ইনিয়ে বিনিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গেয়ে চলেছে গানটার প্রথম দুটো লাইন। এ যে অসহ্য। আমার কান ভোঁ ভোঁ করছে। আমি আর এই গানটাকে সহ্য করতে পারছিনা। বদ্ধ কালা হয়ে গেলে আমি বাঁচি এখন। ধীরে ধীরে চেতনাও যেন লোপ পাচ্ছে। এখানেই, এই গানের অত্যাচারেই এবার আমি মারা পড়ব।
কিন্তু এভাবে শেষ হয়ে যাবো। এতো সহজে। কিছুতেই না। কিছুতেই না। জলে ডোবা মানুষ যেমন বাঁচার তাগিদে শেষমূহুর্তে আঁকড়ে ধরে তৃণ খণ্ড; তেমনি আমিও সর্বশক্তি দিয়ে শেষ বারের মতো চিৎকার করে উঠলাম – “ আর না। আর না। থামো এবার। আমায় মুক্তি দাও। আমই আর পারছিনা।” এর কতোটা যে গলা দিয়ে বেরোল, আর কতোটা যে আটকে থাকল গলাতেই তা বোঝার মতো শক্তি আর আমার রইলনা। তবে গানটা যেন চকিতে ভয় পেয়ে থমকে গেল। হঠাৎ অন্ধকার হয়ে গেল ঘরটা। নূপুরধ্বনি দ্রুত তালে দূরে ফিকে হয়ে এলো। আর আমার চোখে এসে পড়ল এক ঝাঁক জোড়ালো আলো। আমি তখন প্রায় সংজ্ঞাহীন।
কেউ নাড়া দিচ্ছে আমায়। আস্তে আস্তে। এবার জোড়ে। ধাক্কা দিয়ে জাগানোর চেষ্টা করছে আমায়। না আমি আর চোখ খুলবনা। এরকম ভারী চোখের পাতা কষ্ট করে খুলে আমি আর ওই নির্লজ্জ মহিলার মুখ দেখতে চাই না। না না কিছুতেই না। কিছুতেই দেখব না আমি। চোখে মুখে জলের ঝাপটা লাগলো। ঘাড়ে মাথায় কেউ হাওয়া করছে। অনেক দূর থেকে আসা ছেঁড়া ছেঁড়া, ভাসা ভাসা, কিছু কথা যেন শুনতে পারছি। কমলেরই গলা – “সার! সার! উঠে পড়ুন। সব ঠিক হয়ে গেছে। আর কিছু ভয় নেই।” ধীরে ধীরে চোখ খুললাম। খুব সাধারন একটা পুরনো ঘরের অপরিচ্ছন্ন মেঝেতে শুয়ে আছি। ধুলো ময়লার গন্ধ ঘর জুড়ে। জাঁক জমকের কোন চিহ্ন নেই। এতক্ষণ দেখা সেই উজ্জ্বল দৃশ্যপটে কে যেন এক টিন আলকাতরা ছুঁড়ে দিয়েছে। এখন আলো বলতে শুধুমাত্র কমলের হাতে ধরা টর্চ। কমল এখনও বলে চলেছে – “ কতক্ষণ ধরে খোঁজাখুঁজি চলছে। কোথাও না পায়ে শেষে ফোন করা হল। কতোবার। বেজেই চলেছে। ধরেন না কিছুতেই। ঠিক তখনই বুঝিচি , এই শয়তানীর জালেই আটকিচেন। একটু চোখের আড়াল করিচি আর টেনে এনেছে…..” রাগে, ঘৃণায় কমলের মুখে এখন অশ্রাব্য সম্বোধনের ফুলঝুরি ফুটছে। কান পাতা দায়। ফোনটা পকেট থেকে বের করে দেখলাম দশটা বাজতে পাঁচ। পনেরোটা মিসড কল। আবার কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘রুপে তোমায় ভোলাব না’ বাজছে। এটা আমার ফোনের রিঙটোন। আর ফোনের কলার স্ক্রীনে এখন স্ত্রী স্বাতীর মুখ ।
(পরে ভেবে দেখেছি, ঘটনাটি আমার অনুভব ও ভাবনার সাথে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে দেখা স্বপ্নের মিশ্রণ মাত্র, রাজকীয় আতিথ্য নিতে চাইলে চলে আসুন রাজবাড়ী তে ছুঁয়ে দেখুন,অনুভব করুন,৩০০ বছরের প্রাচীন রাজকীয় ইতিহাস কে )
ইতিহাসিক তথ্যসূত্রঃ বঙ্গ সংস্কৃতির ইতিহাস ও গুগল সৌজন্যে
(পরে ভেবে দেখেছি, ঘটনাটি আমার অনুভব ও ভাবনার সাথে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে দেখা স্বপ্নের মিশ্রণ মাত্র, রাজকীয় আতিথ্য নিতে চাইলে চলে আসুন রাজবাড়ী তে ছুঁয়ে দেখুন,অনুভব করুন,৩০০ বছরের প্রাচীন রাজকীয় ইতিহাস কে )
ইতিহাসিক তথ্যসূত্রঃ বঙ্গ সংস্কৃতির ইতিহাস ও গুগল সৌজন্যে
No comments:
Post a Comment